ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পিঠাপুলির আয়োজনে দিলারা খান

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:৫০, ২১ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:১৩, ২১ নভেম্বর ২০২৪

পিঠাপুলির আয়োজনে দিলারা খান

দিলারা খান

ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যিক আবহে চিরায়ত বাংলার রূপশৌর্যের যে সমাহার তা এই অঞ্চলের পরম বরমাল্য। শুধু কি ঋতু বদলের পালা? নাকি তার সঙ্গে আরও জুড়ে থাকে খাদ্য রসিক বাঙালির নানামাত্রিক ভোজনবিলাসের আড়ম্বর। আড়ম্বরই বটে। হেমন্ত কালের শুভাগমনে প্রকৃতি যেমন নব উদ্দীপনায় সাজসাজ রবে মুখরিত তাও এক অনন্য নৈসর্গিক দৃশ্যময়তা। বাংলার নির্মল প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থাকে আবহমান কালের বঙ্গ রমণীরা। যারা খাদ্য রসনার এক চিরায়ত, অনির্বাণ শিল্পী। শৈল্পিক বোধ আর উর্বর পলিমাটির সোঁদা গন্ধ যেন মিলে মিশে একাকার। তার সঙ্গে মিলনগ্রন্থিতে ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামল এই সমৃদ্ধ বাতাবরণটি। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসটি যেন নতুন ধানের উৎসবে, আনন্দে মুখরিত সুফলা বঙ্গভূমির চিরন্তন আবেদন। হেমন্তের ঋতু উৎসব অন্য মাত্রার ভিন্ন সৌরভের। পরিপূর্ণ ও নতুন মন মাতানো ফসলের খেত যেন উপচেপড়া এক অনন্য বাংলার শাশ^ত গৌরব। পিঠাপুলির প্রাণ দোলানো আয়োজনে বঙ্গ রমণীদের যে দিনভর ব্যস্ততা, হরেক মাত্রার যে কর্মদ্যোতনা তাও এক অনির্বাণ দীপ্তি। এমন সব গৌরব সৌরভের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যিক রসসম্ভোগ পিঠাপুলির চমৎকার অভিনবত্ব। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুরনো সম্ভার একেবারে শেষ হয়ে না যাওয়াও চিরায়ত বাংলার অনবদ্য শৌর্য।


আলাপ করছিলাম একজন সফল পিঠাপুলির নতুন সময়ের কারিগর দিলারা খানের সঙ্গে। বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার সুলতানপুর গ্রামের এই রন্ধনশিল্পীর পিঠা সামগ্রীর নতুন আর ঐতিহ্যিক মিলন গ্রন্থি যে সুস্বাদু ও মুখরোচক রসনায় গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়ায় তা যেন নব যুগের চিরায়ত সম্পদ। পিতা তোফায়েল আহমেদ আর মাতা রাশেদা বেগমের কন্যা দিলারা। মায়ের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল চোখে গলা ধরে আসা কষ্টকর অনুভূতি বিষাদঘন এবং শোকাবহ বোধ। ৪ বছর আগে করোনা মহামারির চরম আকালে আক্রান্ত হন মা এই জটিল রোগে। ২০২০ সালের তেমন দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তার জীবন আজও হৃদয়ের নিভৃতে ঝড় তোলে। মাকে বাঁচানো গেল নাÑ এমন আক্ষেপ আর বেদনা নিভৃতে এক অশ্রুসজল অঘটন। তার পরও গতিশীল জীবন থেমে থাকে না। থাকার উপায়ও নেই। নিত্য এগিয়ে চলার আরেক নাম জীবন। আনন্দ-বেদনার মিলিত আবহে। ক্রমান্বয়ে শুনলাম তার জীবনের গড়ে ওঠা গল্প। সুলতানপুরের তৌহিদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক-মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। পরের ধাপও এগিয়ে গেছেন সাবলীল পথচলা আর দৃঢ় প্রত্যয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক ঢাকা বদরুন্নেসা কলেজ থেকে। নরসিংদীর আবহে শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করা এই শিক্ষার্থী রাজধানী ঢাকার নগর সভ্যতার স্পর্শ পাওয়া জীবনের আর এক অভিযোজন। আর পেছন ফিরে তাকাতেই হয়নি। উচ্চ মাধ্যমিকে সফল হয়ে ঢাকার অন্য এক স্বনামধন্য কলেজ সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা শিক্ষাজীবনের অন্যতম মাইলফলক। বিষয় হিসেবে বাছাই করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান আইনের ওপরও তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা এগিয়ে নেওয়া। বিচার কার্যক্রমের হরেক বিধিনিষেধের যৌক্তিক জ্ঞানার্জন এখনো চলছে।
পিঠাপুলির প্রতি আগ্রহ তৈরির পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। সব সন্তানের কাছে প্রথম রান্নার স্বাদ আসে জন্মদাত্রী মায়ের থেকেই। দিলারাও তার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নন। মায়ের রান্না শুধু যে তৃপ্তি করে খেয়েছেন তা কিন্তু বরং অতি উৎসাহে রান্নার প্রতি ঝুঁকে পড়াও ছিল মাকে সম্মান-শ্রদ্ধায় জীবনের চলার পথে সাথী করা। তেমনটাই করেছেন সুবর্ণ এক সময়ে। কিন্তু ঘনঘোর আকাশে কালো মেঘ করোনা যখন সেই মাকেই তুলে নিল তখন টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। পিঠাপুলির বাহারি রান্নাকে পাথেয় করে মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরা, মাকে স্মরণ করা সবই যেন যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ। মায়ের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যাওয়া দিলারা স্মরণ করলেন পিঠাপুলির আয়োজনে প্রথম অর্থ সংযোগ ও মাকে ঘিরেই হয়। পাটি সাপটা, পুলি পিঠা মাংস কিংবা নারিকেলের গুঁড় নয়তো চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়। সেখানে সবার আগে সামনে এসে যায় গ্রাহকের পছন্দ, রুচি তাদের যথার্থ মতামতও। নরসিংদী থেকে সারা বাংলাদেশে কুরিয়ার সার্ভিসে গ্রাহকদের কাছে চলে যায় তাদের পছন্দের পিঠাপুলি। গুড় দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত পিঠার বাহারি আয়োজনও থাকে হরেক বৈচিত্র্যতায়। গুড় মাখানো মানসম্মত পিঠা বানানো সততা, নৈপুণ্য ছাড়াও সমর্পণ নিবেদন বলাই যায়। কাছে ধারের গ্রাহক বাসায় এসে তাদের পছন্দমাফিক পিঠাপুলি ঘরে নিয়ে যায়। উদ্যোক্তার অভিমতে সেটাই নাকি উত্তম। কারণ পিঠাপুলিই অক্ষত থাকে ভেঙে চুরে যায় না। ছড়ানো ছিটানোর বিপত্তিতেও পড়া হয় না। কুরিয়ার সার্ভিসে তেমন শঙ্কা পদে পদে। দিলারা যদিও চান বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া। সেটা কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে অসম্ভব। সেটাও তিনি বোঝেন ভালোভাবেই। আব্বা আর একমাত্র বোনকে নিজের কাছে রেখেছেন সেটাও আনন্দ উপভোগের ভিন্ন স্বাদ অতুলনীয়। নিজের লাউয়ের বাগান আছে। সেখান থেকে লাউ বিক্রিও হয়। কচু ও লাউয়ের পাতাতেই হরেক রসনা খাদ্য সম্ভার মোড়ানো হয়। অনলাইন পেজে তার বেচাকেনা আধুনিকতার নতুন সময়কে স্পর্শ করা। তার জন্য অনেক শুভ কামনা। নতুন গ্রাহক তৈরির সম্ভাবনায়  তার ঐতিহ্যিক পিঠাপুলির বাহার পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হোক।

×