শাহীনূর
কষ্টে ভরা জীবন আমার, কষ্ট নিয়েই বাঁচি/একটা দিনও জানতে চাওনি, আমি কেমন আছি...। কণ্ঠশিল্পী ইমন খানের গাওয়া এই গান হতে পারে ব্যর্থ প্রেমিকের মনে সান্ত¡না, হতে পারে বিচ্ছেদের কষ্টের সান্ত¡না, আবার প্রকৃতির নিষ্ঠুর যাতনায় কষ্টে ভরা মানুষের জন্য গাওয়া। কণ্ঠশিল্পী যে লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এই গান গেয়েছেন, তা নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রত্যন্ত গ্রামের এক নারীর নিয়তির কষ্ট এ গানের উপজীব্য হতে পারে।
এই গান যেন গ্রামের নারী শাহীনূরের কপালে তকমা হয়ে আছে। কষ্টের শেষ নেই এই পরিবারের। ৩ শিশু সন্তান নিয়ে কষ্টের জীবন শাহীনূরের। এক সময় ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, স্বামী কাছে ছিল। এখন কিছুই নেই। প্রমত্তা যমুনা সব কেড়ে নিয়েছে।
শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের গিয়াস উদ্দিন সরকারের ছেলে ইমরান সরকারের সঙ্গে ১০ বছর আগে বিয়ে হয় শাহীনূরের। শ্বশুরের ছিল বড় বাড়ি। পরিবার নিয়ে সবাই ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। স্বামী ইমরান মৎস্যজীবী। মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বছর দুয়েক আগে আগ্রাসী যমুনার ভাঙনে শ্বশুরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরো পরিবারটি। ইমরান-শাহীনূর দম্পতি গোপালপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। কর্মহীন হয়ে পড়ে ইমরান, তিনটি সন্তান নিয়ে সংসারে নেমে আসে অভাব অনটন।
যমুনার ভাঙনে সব হারানো শাহীনূর খাতুন (২৭) এক টুকরো সুখের আশায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছেন। ভেবেছিলেন স্বামী ইমরান হোসেন সরকার মালয়েশিয়ায় কাজ করে টাকা পাঠাবেÑ সেই টাকায় ঋণ শোধ হবে, নতুন বাড়ি হবে, ঘর হবে, সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে বড় করবে। কিছু দিন নাই বা থাকল স্বামীর স্পর্শ। কিন্তু গৃহবধূ শাহীনূরের সে আশার গুড়েবালি। এক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েও কোনো কাজ পায়নি ইমরান হোসেন। এখন বিদেশে বেকার বসে খেয়ে না খেয়ে অসহায় দিন কাটাচ্ছে স্বামী ইমরান, আর দেশে তিন শিশুসন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে গৃহবধূ শাহীনূরকে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মঞ্জিল ফকিরের মেয়ে শাহীনূর খাতুনকে সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতে এখন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে। সংসারের অভাব ঘোচাতে এবং নতুন সুখের স্বপ্নের আশায় পার্শ্ববর্তী চর কৈজুরী গ্রামের আমিরুল ইসলামের পরামর্শে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইমরান। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে ইমরান মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু এক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ পাননি ইমরান। বাড়িতে পাঠানো তো দূরের কথা, উল্টো নিজের খাবার জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিতে হচ্ছে তাকে।
এদিকে ৯ বছর বয়সী ইশামনি, ৭ বছরের সোহাগ ও ৩ বছর বয়সী সন্তান স্বাধীনকে নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে শাহীনূরকে। সংসার চালাতে ও স্বামীকে পাঠাতে আরও ৫০ হাজার টাকা কিস্তির লোন তুলতে হয়েছে তাকে। শাহীনূর বলেন, পাশর্^বর্তী আমিরুল মালয়েশিয়ায় থাকে, প্রত্যেকবার দ্যাশে আইস্যা কোম্পানির মাধ্যমে মেলা লোক মালয়েশিয়ায় নেয়। আমার স্বামী তার কথামতোই গ্যাছে, কিন্তু আর আমিরুল ফির্যা আসে নাই। আমার স্বামীও কাজ কাম ছাড়া এক বছর ধইর্যা বইস্যা আছে।
কাঁদতে কাঁদতে শাহীনূর আরও বলেন, অন্যের বাড়িতে কাম কইর্যা ৫০-১শ’ ট্যাহা পাই, তাই দিয়্যা ছাওয়ালপালের মুহে আহার তুলে দেই। রাইতে ভাত রাইন্দ্যা পরদিন হারাদিন পোলাপানগুলারে পান্তা খাওয়াইয়া রাহি। মালয়েশিয়ায় স্বামীর কষ্টের কথা হুইন্যা ভীষণ খারাপ লাগে। আর প্রত্যেক দিনই পাওনাদারগোরে তাগাদা, গালিগালাজ শুইনতে হয়। জানি না আল্লাহ কবে আমাগোরে সুখের সন্ধান দেব। মেয়ের কষ্টে কেঁদে ফেলেন শাহীনূরের বাবা মঞ্জিল ফকিরও। তিনি বলেন, নদীভাঙনের পরে মেয়ে-জামাই অসহায় হয়ে পড়ে। নিজের গ্রামে একটি বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছি। সংসার চালাতে পারছিল না। তখন জামাই ঋণ করে বিদেশে গেল।
কিন্তু বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পায় নাই। এখন আমারই সংসার চলে না, মেয়েকে কীভাবে দেখব। বাধ্য হয়ে মেয়ে শাহীনূর অন্যের বাড়িতে কাজ করে। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মো. শাহীন আলম বলেন, শাহীনূর খুব অভাবে রয়েছে। তার স্বামী বিদেশে গিয়েও কোনো কাজ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে তিনটি ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে শাহীনূর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করছে।