ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

নৃশংসতার শিকার কল্পনা

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:০৫, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

নৃশংসতার শিকার কল্পনা

নৃশংসতার শিকার কল্পনা

বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যতই চমকপ্রদ হোক না কেন হরেক অপসংস্কারের জাল থেকে আজ অবধি মুক্তি মেলেনি। মধ্যযুগের অমানবিক ঘৃণ্য দাস প্রথা সভ্যতার পরম বিকাশেও তার নগ্ন থাবা বসানোর অপদৃশ্য বিড়াম্বনার ক্ষতদাগ। ইউরোপের তেমন দাস উৎপাদন ব্যবস্থার বিলুপ্তিকরন সভ্যতা সূর্যের অভ্যুদয় বলে ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানীরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে সামাজিক অসমতার জের হিসেবে দাস প্রথা উৎপাদন থেকে ছোট্ট গৃহকোণে আবদ্ধ হওয়া সভ্যতা সূর্যের চরম স্খলন বললেও অত্যুক্তি হয় না।

প্রাচীনকালের পায়ে শিকল বাঁধা দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে পড়া মানুষের চিত্র বিমর্ষ, বিষণœ এবং চরম এক অমানবিকতা। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে যারা মূলত আর্থিকভাবে ততখানি সম্পন্ন নয়। নিজেদের খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে গৃহকর্মী রাখার সামর্থ্যই বা কোথায়? বরং তাদের কোনো শিশু পুত্র কিংবা কন্যাকে অন্যের বাসায় ভাত-কাপড় আর মাসিক বেতনের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেওয়াও প্রচলিত রীতিই বলা চলে।

এসব সম্পন্ন গৃহস্থের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যাদের পরিবারে শিশু পুত্র থেকে কন্যার উদয়াস্ত শ্রমের বিনিময়ে যাপিত জীবনের দুঃসহ সময় পার করে। না থাকে মানবিক মর্যাদা না পায় ন্যূনতম অধিকার, স্বাধীনতা। ভাত-কাপড় আর মাসোহারার বিনিময়ে কাকডাকা ভোর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কাজের ভারে ফুরসত না পাওয়াও পরিস্থিতির বিপন্নতা। তার ওপর আছে নিপীড়ন, নির্যাতনের এক অবাঞ্ছিত পরিবেশ।

স্বস্তি আর নিরাপদে আহার আর গোসলের সময়টুকুও পেতে হিমশিম খাবার চিত্র বহুবার গণমাধ্যমে বিব্রতকর খবর হয়েছে। সম্প্রতি শিশু কল্পনার অকথ্য নির্মমতার কাহিনী শুধু সংবাদপত্রের খবর নয় জনমনেও ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্ত্রী দিনাত জাহান আদরকে আটকও করে। 
১২ বছরের বালিকা কল্পনা। ভাব-কল্পনায় জীবনমন নাড়া দেওয়ার স্পর্শকাতর সময়। শুধু কি তা-ই? বয়ঃসন্ধিকালের নতুন সময়ের অজানা এক শিহরণ। যা উদীয়মান কিশোর-কিশোরীর জন্য অভাবনীয় এক দোলাচল। সময়টা ১২ বছর থেকে শুরু হওয়া এক অনন্য অনুভবের পরম শুভক্ষণ। মাঙ্গলিক ভাব-চেতনায় স্বপ্নের জাল বোনার নিয়ত ঝঙ্কার তো বটেই। সেখানে কল্পনাকে যেতে হয় অন্যের বাড়িতে নিজের ভরণ-পোষণের দায়ভাগ নিতে। শরীর আর মনকে অনেকটা অবজ্ঞা, অবহেলায় দিন-রাত খাটা-খাটনির দুঃসময় পার করা কারোর জন্যই সুখকর কিংবা স্বস্তিদায়ক হয় না।

তার ওপর কন্যা সন্তান বলে কথা। সেখানে আবার গৃহকর্মী কন্যা। অপবাদ, অভিযোগ আর অত্যাচারে নিষ্পেষণ হওয়ার আর এক কঠিন বাতাবরণ তো বটেই। কল্পনার ওপর নির্যাতনের যে অসহনীয় চিত্র গণমাধ্যমে উঠে আসে তা যেমন ভয়াবহ, মারাত্মক একইভাবে সভ্যতা সূর্যের নিমজ্জিত হওয়ার দুরবস্থা তো বটেই। শুধু কি আঘাতের ক্ষতচিহ্ন? আগুনের ছেঁকা দেওয়ার মতো নিতান্ত দগ্ধতাও আলোড়ন তৈরিতে যথেষ্ট। যে পোড়া ক্ষতচিহ্ন জানান দিচ্ছে দীর্ঘ নির্যাতনের চরম দুঃসহ পালাক্রমের আশঙ্কিত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো ছাড়া নিষ্পাপ শিশু কন্যাটির এই মুহূর্তে কোনো গত্যন্তরই নেই। লোমহর্ষক এক নিদারুণ ক্ষতবিক্ষতের দারুণ অগ্নিবাণ। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্নও নাকি চাপা দগদগে দাগ নিয়ে শরীর-মনকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। 
সিলেটের হবিগঞ্জের মেয়ে এই কল্পনা। পিতা শহীদ মিয়া ও মা আফিয়া বেগমের সন্তান। ১২ বছরের বালিকা কল্পনাকে কাজে দিয়েছেন রাজধানীর বসুন্ধরার ভাটারা থানার এক বাসাবাড়িতে। গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান আদরের বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে যুক্ত হয় কল্পনা। কর্ত্রীর নামের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবেন আদর শব্দটি জ্বলজ্বল করছে। যার ছিটেফোঁটা কিংবা বালাই নেই এই গৃহকর্ত্রীর কাজে, নিত্য দিনের ব্যবহারে। তুচ্ছ কারণে কিংবা সামান্য ভুল-ত্রুটি হলে নির্যাতন থেকে কখনো রেহাই না পাবার দুঃসহ ঘটনা এখন অনেকের মুখে মুখে। কখনো লাঠিপেটা করতেন।

মাঝে মাঝে চুল সোজা করা মেশিন দিয়ে গরম ছেঁকা দিতে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারও উঠে এসেছে। ধন্য দিনাত জাহান আদর। নিজের নামে বিষ ঢেলে দেওয়া ছাড়াও মাতৃত্বের মহিমান্বিত সুষমা থেকেও যোজন যোজন ফারাক প্রাচীন যুগের দাস অমানবিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তেমন অসভ্য যুগে ও কালে কোনো মনীষীর লেখায় তা উঠে না আসাও বিকলাঙ্গ সমাজ ব্যবস্থার নগ্ন রূপ। 
তাই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারণের সময়ে গৃহকর্ত্রীর এমন নগ্ন আচরণ, নিষ্ঠুর অমানবিক পেষণ গৃহকোণে আবদ্ধ থাকার কথা নয়। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সাড়া জাগানো নির্মমতার অসহনীয় আঁচড়। গৃহকর্ত্রীকে আটক করা হলেও তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক। কোনো জামিন কিংবা আইনের সামান্য ফাঁকফোকরে এই নিষ্ঠুর মহিলা যেন ছাড়া না পায়। আমরা গৃহকর্মী আদুরী হত্যার বিচার হয়ে নির্যাতনকারির শাস্তি পাওয়ার আইনি কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছি। এ ক্ষেত্রে তার যেন ব্যত্যয় না হয়।

অপরাজিতা প্রতিবেদক

×