স্নেহা
২০২২ সালের কথা। মা-বাবার স্নেহের স্নেহা তখন সবে দশম শ্রেণিতে। সে বছরই তার প্রথম বই ‘ভিনগ্রহী’ প্রকাশিত হয়। পুরো নাম লামিয়া হানান স্নেহা। বর্তমানে সে আইডিয়াল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত।
স্নেহার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ছোট থেকেই লেখালিখি করতে ভালো লাগত। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার তার লেখার বিষয়বস্তু। স্নেহার লেখালিখির হাতেখড়ি তৃতীয় শ্রেণির থেকেই। ছোট্ট বয়সের পাগলামি কখন যে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল, কেউ বুঝতেও পারল না। তার লেখালিখির যাত্রাপথ ছিল পুরোই লুকানো।
কাছের বন্ধুরা দূরে থাক, এমনকি বাবা-মাও কখনো বুঝতে পারেননি যে সে লিখতে ভালোবাসে। ভালোবাসার জায়গা থেকে বড় ভাইয়ার সহযোগিতায় প্রকাশ করে ফেলে তার প্রথম বই। তার প্রথম সায়েন্সফিকশন বইটি সে সময় বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
স্নেহা জানায় লেখালিখির আগ্রহ জমেছে মূলত স্ক্রিপ্ট লেখার মাধ্যমে। ছোট থেকেই তার খুব গল্প বলার অভ্যাস। কিছুটা সত্য কিছুটা বানিয়ে নতুন গল্প নিজের মতো করে বলতে তার মজা লাগত। সেই প্রতিভাই কাজে আসে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকাকালীন। মেভিন ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রোগ্রামে ছোট্ট কমেডি নাটক করবে তারা। সে গল্প লেখার দায়িত্ব পড়ল স্নেহার ওপর। সেটাই তার প্রথম লেখা।
এত অল্প বয়সে বই প্রকাশ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে কি না জানতে চাইলে স্নেহা বলে, কোনো কাজই আসলে বাধাহীন নয়। সবকিছুতেই কিছু না কিছুর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু না। অল্প বয়সে লেখালিখির একটা বড় বাধা হলো অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান। আমার মনে হয় এখনো প্রচুর পরিমাণে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন আমার। অনেক অনেক বই পড়ার অভ্যাস গড়ার প্রয়োজন। আর তাই পরিশ্রমও করতে হয়েছে দ্বিগুণ।
তারপর একটু থেমে হেসে বলল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল আসলে আমাদের পরিবারে, গোষ্ঠীতে কোনো লেখক নেই। তাই আমার বাসায়ও লেখালিখি সম্পর্কে কোনো ধারণা কেউ রাখেনি। তাই প্রথম দিকটায় কারো সাপোর্ট আশাই করিনি। এমনকি আমি বই প্রকাশের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ জানতই না আমি লেখালেখি করতে পছন্দ করি। কারণ আমি জানতাম আমার মত ওইটুকু স্কুল পড়ুয়া মেয়ের লেখক হওয়ার স্বপ্ন অনেকের কাছেই হাস্যকর হবে। আর তাই আমি সবটা নিজের মাঝেই রেখেছিলাম। শুধু জানত আমার বড় ভাই প্রান্ত।
তবে পরবর্তীতে যখন বাসায় জানাই আমি বই প্রকাশ করতে চাই, তখন সকলে অনেকটা অবাক হয়েছিল। বিশেষ করে আমার বাবা এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সবাই বুঝেছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন সবাই কম-বেশি সাপোর্ট করে।
২০২৩ সালে তার থ্রিলার ধর্মী বই ‘অশরীরী’ ও ২০২৪ সালের বইমেলায় ‘সুইসাইডাল মশা’ প্রকাশ পায়। বর্তমানে সে বাংলাদেশের প্রথম থ্রিডি এনিমেশন সিরিজ ঢফ নৎড়ং-এর লেখক হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি সুজন এনিমেশন নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে বাংলাদেশ এবং ভারতের দর্শকের জন্য ভৌতিক গল্পও লিখছে। এ ছাড়াও শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা ‘বেবিটিউব’ প্লাটফর্মের কোর টিমে কাজ করছে সে।
স্নেহা বলে, আমার কাছে কখনোই মনে হয় না খুব দূরে চলে এসেছি। ইনশাআল্লাহ এখনো অনেক পথ বাকি আছে। তবে অনুপ্রেরণার দিক থেকে বলতে গেলে আমি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। নিজেকে সবসময় একটা গল্পের প্রধান চরিত্রের মতো করে ভাবতে ভালোবাসি। তাই বিভিন্ন প্রতিকূলতা সামনে এসে হাজির হলে ভয় হয় না, চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাঁচতেই আনন্দ পাই।
অবসরে স্নেহা বই পড়তে ও শুনতে ভালোবাসে। নিয়মিত ডায়েরিও লেখে সে। তবে বেশি ক্লান্তি থাকলে বিভিন্ন দেশের ড্রামা, ওয়েব সিরিজ, এনিমেশন মুভি দেখে। বিভিন্ন কালচারের বৈচিত্র্য দেখতে তার বেশ ভালো লাগে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, আমেরিকা, তুর্কি, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের কনটেন্ট দেখা তার শখ।
স্নেহা বড় হয়ে কি হতে চায় স্নেহা? বলল, প্রথমত শিক্ষিত হতে চাই। বাবা-মায়ের এবং আমার ছোট ছোট স্বপ্নগুলোর বাস্তবে পরিণত করতে চাই। পাশাপাশি লেখালিখি চালিয়ে যেতে চাই। আরেকটা স্বপ্ন আছে। সেটা হলো অবহেলিত মানুষ এবং প্রাণীর জীবনে একটু হলেও সহযোগিতার চেষ্টা করতে চাই। বাকিটা আল্লাহ্র ইচ্ছা।