হাসিনা আনসার
হাসিনা আনসার। একজন প্রতিষ্ঠিত রন্ধন শিল্পী। একেবারে শৈশব থেকেই রান্নার প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ তাকে বারবার উজ্জীবিত করতো। সঙ্গত কারণে স্নেহময়ী মায়ের রান্নাই ছিল তার আকর্ষণীয় বিষয়। বালিকা বয়সেই মার রান্নার পাশে মোড়া নিয়ে বসে থাকতেন আর উপভোগ করতেন কিভাবে রাঁধতে হয়। হাসিনা জানান, বলতে গেলে মায়ের হাতেই আমার রান্নার হাতে খড়ি। অর্থাৎ ছোট থেকে বড় হওয়ার সুবর্ণ সময়ে পাকা রাঁধুনি মায়ের কাছেই রান্নার তালিম নেওয়ার স্মৃতি আজও স্মরণ চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
পিতা আনসার উদ্দিন আহমেদ রাজা একজন রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজ সেবক হিসেবে বিশেষ সপরিচিত। লালন বাউলের দেশ কুষ্টিয়ায় বড় হওয়া, নিজের স্বপ্নের জগত তৈরি করা জীবনের এক সমৃদ্ধ ভুবন হিসেবেই ভাবেন এখনো হাসিনা। কুষ্টিয়ার প্রসঙ্গ এলেই অতি আবশ্যিকভাবে উঠে আসে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। হাসিনা আনসার তেমন সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ভুবনের সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম করেই সামনে এগিয়ে গেছেন।
ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অবিমিশ্র মিলনের এমন পটভূমিতে হাসিনা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছেন রান্নাও আমাদের চিরায়ত ভৈবব আর শাশ্বত নান্দনিক বোধ। রন্ধন আসলে এক অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্য। সেখানে যেমন সংস্কৃতি আর চিরস্থায়ী ভাবনার ছোঁয়া থাকে পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে আধুনিকতার নির্মাল্যকেও গ্রহণ করে রন্ধন প্রণালিকে সময়ের অনুষঙ্গ করে তোলাই সংশ্লিষ্ট সকলেরই দায়-দায়িত্ব। সেভাবেই হাসিনা তার রন্ধনের যাত্রা শুরু থেকে আজ অবধি অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তার পছন্দের পোশাক নানা মাত্রিকে সময়ের অনুষঙ্গ করে তুলতে একেবারে দ্বিধাহীন ছিলেন।
মা সুরাইয়া আহমেদ যার রান্না দেখে নিজেকে তেমন স্বপ্নের জগতে তৈরি করার আগ্রহ ভেতরের বোধে এখনো জিইয়ে আছে সেই মাতাই তার সকল প্রেরণার উৎস। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে অবলিলায় বলে গেলেন মায়ের অসাধারণ রান্নার কৃতিত্বই শুধু নয় সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার প্রস্তুতেও মার তুলনা যেন তিনি নিজেই। রান্নার গুরু হিসেবে যাকে আজও ধারণ করে চলেছেন। ৩ বোন ২ ভাইয়ের সংসারে বাবা-মা কখনো ছেলেমেয়েদের বিভাজনকে আমলেই নেননি। প্রশ্নটা আমার পক্ষ থেকেই করা হয়।
কারণ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে একজন শিশু কন্যা প্রথম বঞ্চনার শিকার হয় তার নিজ পরিবার থেকেই। শ্বশুরবাড়ি তো অনেক পরের ব্যাপার। হাসিনা নিঃসঙ্কোচে, নিঃসংশয়ে উত্তর দিলেন একেবারেই না। বরং বাবার কাছ থেকে মেয়েরাই বেশি সুযোগ-সুবিধা অর্জন করেছে। স্বাধীন সত্তা নিয়ে বড় হওয়া হাসিনা লেখাপড়া করেছেন কুষ্টিয়া, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। বিষয় হিসেবে ব্যবস্থাপনা বিভাগে সম্মান নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। শিক্ষার পাঠ সমাপ্ত হওয়ার পর পরই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
স্বামীর পরিবারও ঐতিহ্যিকভাবে সম্পদে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এক বনেদি বংশ পরম্পরা। সেখানেও রান্নার মতো ঐতিহ্যিক শিল্পও হাসিনাকে প্রথম থেকেই মুগ্ধতার বিস্ময়ে অভিভূত করে রাখত। শুধু কি তাই? তার ভাশুর নিজের দুই ভ্রাতৃবধূকে নামি-দামি রেস্টুরেন্টে শেফের মাধ্যমে রান্নাকে আরও পরিশীলিত করতে প্রশিক্ষণ করাতেও পিছপা হননি। সঙ্গত কারণেই রন্ধন শিল্পী অভিজাত ঐতিহ্যিক রান্না থেকে শুরু করে আধুনিক সময়ের নানামাত্রিক রন্ধন শৌর্যে পারদর্শী হয়ে উঠতে একেবারে উৎসাহের সঙ্গে নিজেকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।
রান্নার হরেক রকম আয়োজনের চিন্তা যখন ঘুরপাক করে তেমন সময়ে গ্রাম-বাংলার চিরায়ত রান্না নিয়েও ভাবতে বসে যান হাসিনা। সেই সুচিন্তিত ভাবনা থেকেই সারাদেশের ৬৪টি জেলার রান্নার বিভিন্ন উপাদেয় বিষয়ও তার লেখনি শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। নিজের লেখা দশটা বই প্রকাশ করেন গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যিক রান্নার সম্ভার নিয়ে। তার আগে নিজের শিল্পকর্মে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপরও কিছুটা আলোকপাত করেন।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে রান্নার ওপর প্রফেশনাল কোর্স করে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ও নিজের সক্ষমতা এনেছেন। পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে লেবেল-১ লেবেল-২ করে তার পেশাগত জীবন অনেকখানি ভরিয়েও তুলেছেন।
লালন, রবীন্দ্র ভক্ত কুষ্টিয়ার এই প্রতিষ্ঠিত রন্ধন শিল্পী মনে করেন গান, কবিতা এবং গল্পের মতোই রন্ধন একটি সুচারু শিল্পকলা। সাংস্কৃতিক বোধ আর অনুভবে যাকে নিয়তই চর্চা করতে হয়। এখানেও সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা খামখেয়ালি পুরো পেশাকে নয়-ছয় করে দিতে সময় নেবে না। সঙ্গত কারণ সতর্ক, সাবধানতায় ধৈর্যসহকারে রান্নার আয়োজনকে মানস সংস্কৃতিতে ধারণ করে তাকে ব্যবহারিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াও পাকা রাঁধুনিদের সচেতন দায়বদ্ধতা। সেটা যেমন নিজের কাছে একইভাবে গ্রাহক ও সমাজের কাছেও।
অনলাইনে এই রন্ধন শিল্পীর পেজের নাম ‘নাহার কুকিং ওয়ার্ল্ড’। রাজধানীজুড়ে তার ব্যবসায়িক সাফল্য গ্রাহকদের রুচি এবং স্বাদে নিত্যনতুন আবেদন জাগিয়ে তুলছে। বাবা-মার পরিবারে নিজেকে তৈরি করে পরবর্তীতে শ্বশুরবাড়িতেও অনুকূল পরিবেশেও সেই রান্নাকে নিয়ে পেশাগত জীবন সমৃদ্ধ করা সত্যিই এক অভাবনীয় কর্মযোগ। আমরা সবাই হাসিনা আনসারের সফল কার্যক্রমের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
শহিদ