মানবিক বিপর্যয়
নতুন বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এবার বেশ কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত প্রতি বছরের জুন-জুলাই মাসে বন্যা হয়ে থাকে। এবারও এ দুই মাসে বন্যা হয়েছে। কিন্তু এই আগস্টে যেভাবে আচমকা দেশের অনেক অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে সেটা ভাবতে পারেননি বেশিরভাগ মানুষ।
প্রতি বছর দেশের বেশ কিছু জেলার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। বন্যায় প্রাণনাশ থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর ক্ষতি হয়ে থাকে। অবর্ণনীয় এমন দুর্ভোগে নিয়মিতই পড়তে হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষদের। এবার তাদের পাশাপাশি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর কষ্টের সাগরে পড়েছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ। সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষ প্রতি বছরই বন্যার কবলে পড়লেও এবার ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ কষ্টের এ স্বাদ পেয়েছেন প্রথমবার। বন্যায় সীমাহীন কষ্ট আর দুর্ভোগে শীর্ষে থাকে নারী আর শিশুরা।
ভারতের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া ও টানা অবিরাম বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেটসহ অনেক জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে নিরাপদ পানি ও খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এমন অবস্থায় সারাদেশের মানুষ এক কাতারে মিলিত হয়েছেন। যে যেভাবে পারছেন সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছেন। বানভাসি মানুষের জন্য একত্রে আজ সম্প্রীতির বাংলাদেশ। ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সবাই সবার পাশে দাঁড়ানো এখন নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব সময়ই ক্রান্তিতে-সংকটে সবাই মিলে একটি বাংলাদেশ। এবারের বন্যায় সে স্বাক্ষর আরেকবার দেখিয়ে চলেছেন দেশের মানুষ।
বন্যায় আক্রান্ত বিভিন্ন জেলায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন মানুষ। অনেক জেলায় মহাসড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্ধারকারী ও ত্রাণ সরবরাহকারী গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। বন্যার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখছেন ফেনীর বাসিন্দা।
জেলাটির ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর এই ছয় উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। এসব এলাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দি। ফেনীর অনেক জায়গায় নেই বিদ্যুৎ ও মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক। খাবার ও পানির সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে নারী ও কোমলমতি শিশুরা আছেন সবচেয়ে অসহায় অবস্থায়।
বন্যায় বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন নারী ও শিশুরা। তবে তারা আছেন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। বিশেষ করে শিশুদের নিরাপদ স্থান, নিরাপদ খাদ্য, পুষ্টি নিশ্চিত ও নিরাপদ স্যানিটেশন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় জনগণ ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে পরিবারগুলোকে। ফলে বসবাসের পর্যাপ্ত উপকরণ নেই আশ্রয় কেন্দ্রে।
শিশুদের গোসল করানো বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছেন না অভিভাবকরা। একদিকে যেমন স্যানিটেশন সমস্যা অন্যদিকে শিশুদের নিরাপদ স্থান ও পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পারছে না। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে হাজার হাজার শিশু রয়েছে। বন্যার প্রকোপে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ ও অস্বাস্থ্যকর নোংরা পানির প্রভাবে বিভিন্ন রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে শিশুরা।
শিশুদের পাশাপাশি নারীরাও পড়েছেন বিপাকে। অতিরিক্ত মানুষের উপস্থিতিতে আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় বড় সমস্যার মুখে পড়েছেন নারীরা। নারী ও পুরুষ এক টয়লেট ব্যবহারের ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতেও ভুগছেন নারীরা। এ ছাড়া মেয়েদের ঋতুবতী সমস্যাও বড় প্রভাব ফেলছে বন্যা। আমিনা বেগমের বয়স ৫৫ বছর। তিনি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ প্রসঙ্গে বলেন, কেনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। কোমর সমান পানিতে বাচ্চাগুলো তলিয়ে যাচ্ছিল।
ওদের বাঁঁচাতে স্কুলে আসি। এখানে খাবার দিচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু বাচ্চাদের গোসল করাতে পারছি না। ঠিকমতো খাবার দিতে পারছি না। টয়লেট ব্যবহার করতে পারছি না আমরা। অনেক মানুষের জন্য মাত্র কয়েকটা টয়লেট। তাও আবার নোংরা ও অপরিষ্কার।
ফেনী জেলার ছয় উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়ন বন্যার পানিতে ডুবে আছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পানিতে ডুবে আছে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের ঠিকানা হয়েছে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে, স্থানীয় মসজিদ ও মন্দিরে। বিভিন্ন স্কুলের ছোট ছোট কামরায় জবুথবু হয়ে রয়েছেন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী ও পুরুষ, শিশু ও তরুণ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।
বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ফেনী সদরের কালীদহ, বালিগাঁও, ৯ লেমুয়া, ১০ ছনুয়া ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব গ্রামের বেশিরভাগ একতলা ঘর তলিয়ে যায়। ফসলি জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট সবকিছুই ডুবে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেউ কেউ কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আবার কেউ বুক পানি সাঁতরে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন।