ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

আসমার জীবন লড়াই

সোহেলী সুহী

প্রকাশিত: ০১:১৮, ৯ আগস্ট ২০২৪

আসমার জীবন লড়াই

আসমার জীবন লড়াই

পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জীবন আপন বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময়। জীবন সংগ্রাম সবারও একই রকম নয়। ঠিক যেন জীবন যেখানে যেমন। প্রাত্যহিক জীবনে সচেতন দৃষ্টি ফেললেই দেখা যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বৈচিত্র্যময় জীবন সংগ্রামের অজস্র উদাহরণ। আর সংগ্রামী নারীদের জীবন তো হয় আরও নাটকীয়।

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার বা বাসাবাড়িতে কাজ করা নারী সবার জীবনই একেকটি অলেখা গল্প যার মূল উপজীব্য তাদের সংগ্রাম, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প অথবা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিনিয়ত করতে থাকা আপ্রাণ চেষ্টা। স্বপ্ন কখনো নিজেকে বাস্তবায়ন করতে হয়, কখনো তা সন্তানকে ঘিরে আবর্তিত হয়। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের জন্য নারী হয়তো তখন বেছে নেয় তার সন্তানকে।

নিজের জীবন তুচ্ছ করে হলেও সন্তানের ভবিষ্যৎ সুখ সমৃদ্ধির জন্য তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। এমনই একজন নারী আসমা বেগম। ভ্যানচালক পিতা মো. শমসের আলী অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য কোনোদিনই দেখেননি। আসমার মায়ের নাম সালেহা বেগম। আসমা বেগমের বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন তার মা মারা যান। তিন মেয়ে আর এক ছেলের পিতা মো. শমসের আলী তখন অথৈ সাগরে পড়েন বৈ কি।

কিন্তু সন্তানদের বুকে আগলে রেখে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রচ- অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দরুন সন্তানদের শিক্ষিত করার সুযোগ হয়নি। আসমা বেগম জানালেন মায়ের মৃত্যুর পর অন্যদের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে কাজ করেছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলেও গিয়েছেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়ার সুযোগ হয়নি। চল্লিশের কোটায় এসেও আজও তার স্কুল গড়পাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্মৃতি তাকে উদ্বেলিত করে।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভ্যানচালক নুরুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর ঘর আলোকিত করে আসে দুই মেয়ে এক  ছেলে। বড় মেয়ে নূরুন্নাহার আক্তার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি। কিন্তু তারপরও আসমা বেগম তার পড়াশোনার প্রতি যতœশীল। মেয়েটি যাতে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে সেজন্য তার মন সবসময়ই ব্যাকুল থাকে। তার মতে এমনিতেই আমাদের সমাজে নারীরা অবহেলিত।

আর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও কঠিন পরিস্থিতি পার করতে হয়। তাই সুশিক্ষিত হয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মেজো মেয়ে চায়না আক্তারও মায়ের উৎসাহে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবেও ক্লাসে পরিচিত। মেয়ের এমন সাফল্য আসমা বেগমের আশার আলো আরও প্রজ্বলিত করে।

মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় তার বিয়ে হলেও নিঃসঙ্গ পিতার দেখভাল করার নিমিত্তে স্বামী সন্তানসহ তিনি বাবার বাড়ি থাকেন যা মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। একমাত্র ছেলেকেও মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন। অসুস্থ পিতা, অসুস্থ স্বামী, অসুস্থ শাশুড়ি সকলের দেখভাল করা আর সন্তানদের পড়াশোনা করানো সকল দায়িত্ব এই দেবী দুর্গাসম নারী আসমা বেগমের। ঝাড়ু দেওয়া, মাটি কাটা, অফিসে ফরমায়েশ খাটা সকল কাজে তাকে দেখা যায়। তার দিন শুরু হয় কাক ডাকা খুব ভোরে। সংসারের কাজ সেরে নিজ কর্মস্থলে আসা।

অতঃপর সূর্য ডোবার মুহূর্তে বাড়ি ফেরা। আবার সেই গৃহ কোণে সন্তানদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বুননের কাজ চলে। হাসিমুখে জানালেন সন্তানদের ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত নিজেই পড়িয়েছেন। বলার ভঙ্গিতে ছিল গৌরব যা উপেক্ষা করা যায় না। অতীত স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বললেন, স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে তিনি অথৈ সাগরে পড়েন। ঠিক তখন গড়পাড়া ইউনিয়নের তারিখ হোসেন তাকে মাটি কাটার কাজ দেন।

কাজে চটপটে আর পরিশ্রমী হওয়ায় সবাই তাকে পছন্দও করে। আরও জানালেন গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফছার উদ্দিন সরকার তার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকার প্রদত্ত টিসিবি পণ্যের কার্ডও দিয়েছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে স্কুল এবং এলাকার বাসিন্দাদের সেই সঙ্গে সুহৃদ ব্যক্তিদের অবদানের কথা স্বীকার করলেন নিঃসঙ্কোচে। জানালেন, তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমার সন্তানদের পড়াশোনা করানো আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আসমা বেগমের স্বপ্ন তার তিন সন্তান পড়াশোনা শেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থনৈতিক অভাবে তিনি পড়াশোনা করতে না পারলেও সন্তানদের সে অভাব তিনি বুঝতে দিতে চান না বলেই সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি তার কাজ চলে। মায়ের মমতার কাছে হার মেনে যায় অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম।

×