ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বন্যায় দুর্ভোগ

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০২:০১, ১২ জুলাই ২০২৪

বন্যায় দুর্ভোগ

বন্যায় দুর্ভোগ

১০দিনের বেশি সময় ধরে কুড়িগ্রামসহ সারাদেশের নানা অঞ্চলে চলছে বন্যা। বন্যার এ দিনগুলোতে মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের কষ্ট আরও বেশি। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের দিনগুলোতে এক প্রকার জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হয় তাদের। একদিকে নিজের জীবন, স্বামী, সন্তান ও তাদের গবাদীপশু গুলিকে নিয়ে টিকে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। নারীদের এই সংগ্রাম শুধু আজকের নয় শত শত বছর আগে থেকে চলে আসছে। তারপরও এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ জয়ী সংগ্রামী এই নারীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ এই বাংলাদেশ। কখনো শীত কখনো গরম আর কখনো বর্ষা যেন লেগেই থাকে এই দেশে।

কয়েকদিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এদের কেউ কেউ ঘরবাড়ী ছেড়ে বিভিন্ন উঁচু বাঁধ, মানুষের বাড়িতে খোলা জমি অথবা কোনো আবাসনে আশ্রয় নিয়ে আছে। অনেকে জায়গার অভাবে শুধু একটা পলিথিন টাঙ্গিয়ে বৃষ্টির মাঝে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। অনেক পরিবার ঘরের মাচানে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে। অনেক মহিলা আবার সংসারে নানা জিনিসপত্রের কারণে ঘরবাড়ি না ছেড়ে ঘরেই পানির মধ্যে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে।

বন্যার এই দিনগুলোতে পুরুষের চেয়ে নারী আর কিশোরীদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হয়। যেটা কখনোই কাউকে বলতে পারে না। নীরবে কঠিন এই সময় পার করে নারীরা। নানা শারীরিক সমস্যা হলেও এ সময় কোনো চিকিৎসা সেবা পায় না। সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে রান্না করা,  গোছল করা আর প্রাকৃতিক ডাক সারা দিলে অথবা কারও মাসিক শুরু হলে খুব কষ্ট হয় তাদের। মহিলা আর কিশোরীদের কি যে অবর্ণনীয় কষ্ট হয় যা না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা দুধকুমোরসহ জেলার ১৬টি নদীতে পানি আর পানি। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছে।

ঘুরে বেরিয়েছি ধরলা পারের বিভিন্ন গ্রামে। ধরলা পারের হোলখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রামে জাহানারা বেগমের বাড়ি। বাঁধের নিচে ঝুপরি ঘরে এক হাঁটু পানি। তিনি পাশর্^বর্তী ঈদগাহ মাঠে আশ্রয় নিয়ে আছে। প্রতিবেশী কুলসুম গরু ছাগল নিয়ে ভাইয়ের বাড়ির পাশের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে সন্তানদের নিয়ে। রান্না করার জায়গা নেই। বাঁধের রাস্তায় রান্না বসালেও বৃষ্টির কারণে সব ভিজে গেছে। চরম দুরবস্থায় পড়েছে। শুধু জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শুকনো খাবার খেয়ে।

কুলসুমের স্বামী না থাকলেও সন্তানদের জন্য রাতের রান্না চড়িয়ে দিয়েছে শেষ বিকেলে। পানির কারণে কোথাও রান্না করার মতো অবস্থাও নেই। বাধ্য হয়ে রাস্তায় রান্নার আয়োজন। সন্তানরা ক্ষুধার জ¦ালায় কান্নাকাটি করে। তারা শুকনা খাবার খেয়ে থাকলেও সন্তানদের জন্য রান্না করতে হয়। বন্যার দিনগুলোতে দিন-রাত মিলে একবার মাত্র খাবার খায়। মাটি কাটার কাজ করে। এখন কাজ নেই। মানুষের কাছে ধারদেনা করে চলছে কোনো রকমে। শুধু জাহানারা বেগম ও কুলসুম বেগম নয় জেলার ৪-৫টি চর-দ্বীপ চরের গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক নারীর একই অবস্থা। এ সময় গ্রামীণ সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে খাকায় বন্যা কবলিত মানুষরা ডিঙ্গি নৌকা আর ভেলায় যাতায়াত করে। বন্যার সময় জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদক নারী আর কিশোরীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখার জন্য পাঁচগাছি ইউনিয়নের উত্তর নওদাবস, সিতাইঝার, নওদাবস, গোবিন্দপুর, ওয়াবদাবাজার, কদমতলা, ঝুনকারচর, যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালীর আলগা,  পোরার চর, জগমোহনের চর, চর যাত্রাপুর ও ভগবতীর চর গ্রাম ঘুরে বেরিয়েছেন। দেখেছেন নারী আর কিশোরীদের কি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। উত্তর নওদাবসের রাসেদা বেগম (৩২) স্বামী মনির হোসেন তাদের তিন সন্তান আরজিনা (৪৫) স্বামী মজনু, শাহিদা (৫২) স্বামী মজিবর সবার ঘরেই এক হাঁটু পানি। তারা বলেন, বন্যার দিনগুলোতে চরম কষ্টে কাটাতে হয়। শত কষ্টেও ঘরের চৌকির ওপর দিনরাত মিলে একবার রান্না করেন তারা। ঘরের মধ্যে গোছল ও সারেন। কাপড় না শুকালেও বাধ্য হয়ে ভেজা কাপড় পড়ে থাকেন তারা। তারা জানান প্রাকৃতিক ডাকে যখন সারা দেয় তখন পানির মধ্যেই ছোট্ট ভেলা আর ডিঙ্গি নৌকায় অন্ধকারে বের হয়। সেখানে চলে এই কাজ। তারা আরও জানান তাদের গরু ছাগল গলি নিয়ে চরম কষ্ট হয়। কোথাও খাবার নেই। বাঁশের পাতা কচুরিপানা তাদের খেতে দিয়ে কোনো রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। চর সারডোব স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আকলী বেগম মুসল্লিপাড়া দাখিল মাদ্রাসার ছাত্রী আরফিনা বেগম, চর চাকেন্দা খান স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী লিজা, ঝুনকার চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মনি বেগম, কাঁঠাল বাড়ি গালর্স স্কুলের ছাত্রী রিতা মনি সবাই কিশোরী। তারা জানায় বন্যার দিনগুলোতে মাসিক শুরু হলে চরম কষ্টে পড়তে হয়। শুকনো সময়ে তারা জয়া সেনেটারি নেপকিন ব্যবহার করলেও বন্যার সময় তা হয়ে ওঠে না। তাদেরকে কাপড় ব্যবহার করতে হয়। উপায় থাকে না। এ সময় সেনেটারি ন্যাপকিন কেনার মতো অবস্থা থাকে না। বাধ্য হয়ে কাপড় ব্যবহার করে। পানির মধ্যে ভেজা কাপড় পড়ে থাকতে হয়। তখন ঘরে শুকনো পাওয়া খুব কঠিন। ইনফেকশন হওয়ার ভয় থাকলেও উপায় থাকে না। প্রকৃতির কাছে তারা অসহায়। তারা অনুরোধ করে বিভিন্ন সময় যে ত্রাণ দেওয়া হয় সেখানে যদি এক প্যাকেট সেনেটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয় তাহলে তাদের দুর্ভোগ কমবে অনেক। 
সন্যাসী গ্রামের সুমী বেগম (৩৫), মনিষা বেগম (২৫) জানায় তাদের ঘরে এখন এক বুক পানি। তারপরও ঘর বাড়ি ছাড়েনি। মাচানের ওপর আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাচ্ছে সন্তানদের নিয়ে গরু ছাগল পাশর্^বর্তী বাঁধে রেখেছে। সারা রাত পাহাড়া দেয়। বন্যার সময় গরু ছাগল চুরির ভয় সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কষ্ট হয় যে রাতে বৃষ্টি আর ঝড় বাতাস হয়। তখন প্রকৃতির ডাক সারার সময় নানা কষ্ট সহ্য করতে হয়। তবে তারা বলেন এ সময় সবাই সহযোগিতা করে তাদের। 
বন্যা আসে বন্যা যায়। এ সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু বন্যার্তদের জন্য শুধু শুকনো খাবারের চিন্তা করি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অন্য। খাবারের পাশাপাশি বিশেষ করে নারীদের জন্য আলাদাভাবে ভাবা দরকার। বন্যা কবলিত নারীরা চরম কষ্টে আর দুর্ভোগে পড়ে। তাদের স্বাস্থ্য সেবাটিও খুব জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি নারীদের প্রিয়ডকালীন সময়ের জন্য  সেনেটারি ন্যাপকিন ও ত্রাণের মাঝে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বন্যা বিশেষজ্ঞরা। তা না হলে নারী ও কিশোরীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

×