ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বন্যায় নারীর সংগ্রাম

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০২:০০, ১২ জুলাই ২০২৪

বন্যায় নারীর সংগ্রাম

বন্যায় নারীর সংগ্রাম

প্রতি বছরের জুন-জুলাই মাস মানেই যেন বন্যা! দেশের বেশ কিছু জেলার মানুষ এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। বন্যায় প্রাণনাশ থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর ক্ষতি হয়ে থাকে। অবর্ণনীয় এমন দুর্ভোগের মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বেশ কিছু স্থান শীর্ষে থাকে। প্রতি বছরই এ সকল জায়গার মানুষদের বন্যার সময় সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়। এর মধ্যে নারী-শিশুদের কষ্টই বেশি। 
এবার প্রায় এক মাসে দুই দফা বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দারা। এ দফার বন্যায় ইতোমধ্যে ডুবেছে দুই জেলার বিস্তীর্ণ অনেক এলাকা। ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই জেলার অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় যান চলাচলে বিঘœ হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরেরও অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

গত ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা শুরু হয়। দুই সপ্তাহ স্থায়ী ওই বন্যায় পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন ফের বন্যা দেখা দেয় সিলেটে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার দিন ভোর থেকে অতিভারী বর্ষণে তলিয়ে যায় সিলেট নগরসহ জেলার বেশিরভাগ এলাকা। এ বন্যার পানি ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে সিলেটের সব উপজেলার অন্তত ১৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
এরপর নামতে শুরু করে দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি। এ দফা বন্যার পানি পুরো নামার আগেই ১ জুলাই থেকে সিলেটে ফের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢলে কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। টানা তিন দফা বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। অনেকের ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে। সিলেট মহানগরেরও অনেক জায়গায় নতুন করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা, কুয়ারপার, শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহর, হাওয়াপাড়া, যতরপুর, মেন্দিবাগ, তোপখানা, মজুমদারি, চৌকিদেখী, দক্ষিণ সুরমাসহ বেশকিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। একইসময় পানি বৃদ্ধির কারণে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে প্লাবিত বাড়ি-ঘরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে গেছেন। এছাড়া বিভিন্ন বাজার তলিয়ে পানি ঢুকেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে নতুন করে ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এবারের বন্যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছে প্রশাসন। এমন বন্যায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নেওয়া নারী ও শিশুরা ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে শিশুদের নিরাপদ স্থান, নিরাপদ খাদ্য, পুষ্টি নিশ্চিত ও নিরাপদ স্যানিটেশন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় জনগণ ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে পরিবারগুলোকে। ফলে বসবাসের পর্যাপ্ত উপকরণ নেই আশ্রয় কেন্দ্রে। শিশুদের গোসল করানো বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছেন না অভিভাবকরা। একদিকে যেমন স্যানিটেশন সমস্যা অন্যদিকে শিশুদের নিরাপদ স্থান, ও পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পারছে না। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অন্তত ৭ হাজার শিশু রয়েছে। বন্যার প্রকোপে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ ও অস্বাস্থ্যকর নোংরা পানির প্রভাবে বিভিন্ন রোগ জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। 
শিশুদের পাশাপাশি নারীরাও পড়েছেন বিপাকে। অতিরিক্ত মানুষের উপস্থিতিতে আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় বড় সমস্যার মুখে পড়েছেন নারীরা। নারী ও পুরুষ এক টয়লেট ব্যবহারের ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতেও ভুগছেন নারীরা। এছাড়া মেয়েদের ঋতুবর্তী সমস্যাও বড় প্রভাব ফেলছে বন্যা। সাহেদা বানু নামের এক নারী বলেন, ঈদের আগের রাতে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। কোমর সমান পানিতে বাচ্চাগুলো তলিয়ে যাচ্ছিল। ওদের বাঁচাতে স্কুলে আসি। এখানে খাবার দিচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু বাচ্চাদের গোসল করাতে পারছি না। ঠিকমতো খাবার দিতে পারছি না। নাস্তা বানাব সেটাও পারছি না। টয়লেট ব্যবহার করতে পারছি না আমরা। অনেক মানুষ কিন্তু এখানে দুইটা মাত্র টয়লেট।
সিলেটে অসহায় মানুষ ও গবাদিপশুর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন সেখানকার বাসিন্দা রতন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আমরা বন্যাকবলিত ছামারাকান্দি, ফেদারগাঁও, বেতমুড়া, ছগাম, হুড়ারপাড়, সালুটিকর, খাগাইলসহ অনেক গ্রাম ঘুুরে দেখেছি। সবখানে অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কোনো রকমে মাথাগুঁজে আছে সবাই। বিশুদ্ধ খাবারের সংকট চরমে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুরও অবর্ণনীয় কষ্ট দেখেছি। অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশু সঙ্গে করে এনেছেন। বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর নিজ নিজ বাড়িতেও ফিরছেন সবাই। কিন্তু সেখানে নিজেদের সঙ্গে গবাদিপশুর খাদ্য সংকটও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।’ সেখানে এক গৃহিণী বলেন, ‘এক বেলা খাবার পেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। মানুষের মতো গরু-ছাগলেরও একই দশা। তবে অবলা প্রাণীকে যতটা সম্ভব যতœ করার চেষ্টা করছি। ওরা তো আর কষ্টের কথা বলতে পারে না।’

×