মুক্তার সঙ্গে মিতালি
ফারজাহান আক্তার মুক্তা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যার পৈতৃক নিবাস। পিতা আবদুল মান্নান। মা সামছুন নাহার বেগম। পাঁচ বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থতম। পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ সুপারভাইজার। বাবার পেশার সূত্রে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শৈশব কাটানো ছোট বেলার এক অনন্য স্মৃতি মধুরতা।
তবে বিদ্যালয় গমনের নতুন সময় থেকে নিজ জেলা নোয়াখালীতে চলে আসাও শিক্ষা জীবনের আর এক নতুন পালাক্রম তো বটেই। নোয়াখালীর প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই শুধু নয় শুরু থেকে সহশিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে মানুষের ভাবনায় নিজেকে গড়ে তোলা শিক্ষার্থী জীবনের সুন্দর সময় আজও নাড়া দেয়। পরিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বরাবরই সমতাভিত্তিক পরিবেশে জীবন গড়ে তোলা অনন্য পাওনা।
বালিকা থেকে যুবতী কখনোই শিশুকন্যা কিংবা মেয়ে হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করতে হয়নি। মা ছিলেন পাকা রাঁধুনী। তার চেয়েও বেশি সুগৃহিণীর মর্যাদায় পুরো পরিবার সামলানোর এক নারী শক্তির আধার। আর পিতা বরাবরই ৫ কন্যাকেই সযতেœ সাবলিলতায় তৈরি করতে পাশে থেকেছেন। একইভাবে মায়ের দেখভাল যতœ আত্তিতেও পুত্র-কন্যার ভেদাভেদ সামনেই আসেনি।
সুস্থ, স্বাভাবিক, অনুকূল এক পরিবেশ মুক্তাকে ঝিনুক, মুক্তার প্রতি যে মাত্রায় আগ্রহান্বিত করে তোলে সেটাই গড়ে ওঠা জীবনের হরেক পালাক্রমের অবধারিত সংযোজন। সমুদ্র পরিবেষ্টিত, নদীবিধৌত আর বৃষ্টির ধারায় সিক্ত পলিমাটির নরম সোঁদা গন্ধে ব্যাকুল হওয়া যেন চলমান গতিময়তার নিরবচ্ছিন্ন যোগসাজশ। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেন প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে।
আর উচ্চ মাধ্যমিক কফিলউদ্দিন ডিগ্রী কলেজ থেকে। ¯œাতকও করলেন সংশ্লিষ্ট মহাবিদ্যালয়ের আঙিনায়। আর ¯œাতকোত্তরের জন্য ভর্তি হলেন নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে কনের সাজে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। জীবনের আর এক নতুন জগতের ভিন্নমাত্রার আহ্বান বৈকি। তবে জন্মদাত্রী মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ কন্যা মুক্তা সাবলিলভাবে ব্যক্ত করলেন মানুষের মর্যাদা গড়ে ওঠায় মায়ের অভাবনীয় দায়বদ্ধতার কথা।
ভরা সংসারে তৈরি হওয়ার সুবর্ণ সময় আজও অন্তরের নিভৃতে জিইয়ে আছে। মায়ের আদর্শে তৈরি হতে গিয়ে নিজেকে নিঃশর্তে উজাড় করে দেওয়ার ব্রত যে মাত্রায় শ্বশুরবাড়িতে দিতে পারলেন সেটা প্রতি মুহূর্তে তাকে প্রাণিত ও উদ্বেলিত করে যায়। পরের বাড়ি যাওয়া মনেই হয়নি কখনো। বরং স্বামীর ঘরের আঙিনাও তাকে অচ্ছেদ্য এক নিঃস্বার্থ বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। স্বামী কর্তাটিও সুশিক্ষিত।
একইভাবে উদার, মানবিক আর সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় কার্পণ্য করেননি। তারই অভাবনীয় প্রতিবেশ মুক্তাকে নিজ বাণিজ্যিক পেশায় আরও বেশি নিমগ্ন করে দিতে নিয়ামকের ভূমিকাই বলা যায়। শিক্ষা জীবন সমাপ্ত হলে নতুন করে মুক্তা-ঝিনুকের ব্যবসায় নিজের কর্মযোগকে আবৃত করা সবই সম্ভব হয়েছে নিত্য সাথী স্বামীটির উৎসাহ আর ঔদার্যে। তবে ব্যবসায় নিজের পেশাগত জীবনকে উৎসর্গ করতে গিয়ে সফলতার হাতছানি, সবসময় তার নিত্য অনুষঙ্গ হয়েছে।
তা না হলে কর্মযোগটিই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতে সময় লাগতো না। বিশেষ করে মুক্তা, ঝিনুক আর পুঁতি দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাই আলাদা। সবই সমুদ্রের লোনা পানির ধারে কাছেই সুলভ মূল্যেই শুধু নয় খাঁটি মুক্তা পাওয়াও এক অনন্য বিষয়। তবে পার্থক্য করা খুব কঠিন নয়। আসল-নকল ধরা যদিও বেশ মুশকিল। তবে সততা আর স্বচ্ছতার সঙ্গে বাণিজ্যিক কর্মযোগ সামলাতে সব দিকে নজর রাখাও কর্মজীবনের পরম নিষ্ঠা।
তেমন পেশাগত ব্যবস্থাপনায় সুস্থির আর নির্বিঘœ থাকতে অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়। যেমন গ্রাহককে যথাসম্ভব তার যোগ্য সম্মানটুকু দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে সব সময় দ্বিধাহীনভাবে এগিয়ে আসতে হয়। চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। ব্যস্ততম কর্মযাত্রার মধ্যে সময় সুযোগ করে সাংসারিক আলয় সামলাতেও নিজেকে কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। পারিবারিক রান্নার জোগাড় করতেও মুক্তা কখনো গাফিলতি করেননি।
চেষ্টা করেছেন স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিসম্মত, সুস্বাদু রান্না সবাইকে পরিবেশন করে নিজ হাতে খাওয়ানোর আনন্দ যেন সারা জীবন ধরেই থেকে যায়। এমন আশা ব্যক্ত করলেন মুক্তা। তিনি কিন্তু একজন পাকা রন্ধনশিল্পও। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো স্মৃতিও মাধুর্যে ভরা। তবে স্বামীর আন্তরিকতা, সাহচর্য আর অনন্য সহযোগিতা সব সময় পাশেই থাকে। কিন্তু মা-বাবা দুজনই গত হলেও নিজের মনের নিভৃতে জীবিত থাকেন অনুক্ষণ।
তাদের আশীর্বচনে যেন সিক্ত হওয়া। এটাই বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবনের অশেষ প্রাপ্তি। দুই পুত্র সন্তানের জননী মাতৃত্বের মহিমায়ও নিজেকে আবৃত করে রাখেন। সন্তানদের লেখাপড়া, যতœআত্তির যতখানি সম্ভব কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও সময় দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তবে মূল বিষয় যেটা সেটা হলো তার ব্যবসা বাণিজ্যের ক্রমান্বয়ে প্রসার লাভ করা। আবার প্রযুক্তির আঙিনায়ও তার ব্যবসার পেইজ আছে। সেখান থেকে অর্ডার দিয়েও গ্রাহক নিজেই পছন্দ করে মুক্তা, ঝিনুক,পুঁতির অলঙ্কার কিনতে পারেন। মুক্তা নিজেই আসল নকলের প্রভেদ গ্রাহকের কাছে স্পষ্ট করে দেন।
তবে ব্যবসার এখন মূল উপাদানে প্লাস্টিকের বিষয়টাও সম্পৃক্ত করেছেন। বিশেষ করে বিয়ের গায়ে হলুদে তাজা ফুূল দিয়ে যেমন কন্যা আর আসর সাজানো হয়। সময়ে তা প্লাস্টিকের ফুল দিয়েও আয়োজন, আড়ম্বর করতে হয়। খবরটা গ্রাহকদের জানিয়েও দেন। ব্যবসার শুরুতে সাজানো গোছানোর রূপচর্চার আঙিনা ছিল। যাকে পরিচিত সুন্দর ভাষায় পার্লার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সেটাও তার বর্তমান কর্মযোগের এক আবশ্যকীয় পর্যায়। চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবকিছু দৃষ্টিনন্দন করে সামলিয়ে, গুছিয়ে গ্রাহকদের আকর্ষণ বাড়ানো। পেশাটাও তো নান্দনিক, দর্শনীয় অনন্য সাজগোছের হরেক পালাক্রম। কখনো মুক্তা, কিছুটা ঝিনুক কিংবা পুঁতি। এছাড়া আছে তাজা ও প্লাস্টিক পুষ্পের চমৎকার অভিনবত্ব। ব্যবসাবাণিজ্যে আমাদের নারী সমাজ গত শতকের শেষ দশকেও খুব বেশি এগিয়ে আসেনি।
বরং চলমান শতকের গত দুই যুগের অবারিত কর্মযোগই শুধু নয় সফলতাও সমসংখ্যক নারীর নতুন জীবন গড়ার ধারাবাহিক কার্যক্রম। সঙ্গতকারণে ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্পে নারীদের অভিগমন আজ আর হাতে গোনার অবস্থায়ই নেই। শুধু ব্যবসা নয় বৈচিত্র্যময় হরেক পেশায় নারীরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রচলিত সমাজ সংস্কারের নবতর অধ্যায় তো বটেই।
নিজের নামের সঙ্গে ব্যবসায় জড়ানো দামি গহনা মুক্তা মাণিক্য সত্যিই এক অভাবনীয় বন্ধন। এভাবেই মুক্তা চলবে তার আপন গতিময়তায় বাণিজ্যিক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। পাশে জ্বলজ্বল করুক মনি মানিক্য মুক্তাটিও।
অপরাজিতা প্রতিবেদক