ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

কিশোরীর ঝুঁকি

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:০০, ১ মার্চ ২০২৪

কিশোরীর ঝুঁকি

বাংলাদেশ উন্নয়নের দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধিতে দেশ-বিদেশে নজর কাড়া

বর্তমান সরকার কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ করে প্রাথমিক-মাধ্যমিকে সমতাভিত্তিক কাঠামো হরেক কর্ম প্রকল্পে অব্যাহত রেখেছে। উপবৃত্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা গ্রামগঞ্জে অবারিত করে শুধু শিক্ষা নয়, নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে 

বাংলাদেশ উন্নয়নের দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধিতে দেশ-বিদেশে নজর কাড়া। শুধুমাত্র অবকাঠামোগত সমৃদ্ধি দেশের সার্বিক মঙ্গলে বারবার হোঁচট খায়। কারণ যান্ত্রিক সভ্যতায় চলমান থাকে দৃশ্যমান এবং বস্তুগত সংস্কৃতি। আর মানস সংস্কৃতিতে ভর করে থাকে চিরায়ত অপসংস্কার, মান্ধাতা আমলের জীবনবোধ। যা কোনো সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রাচীরসম ব্যবধান তৈরি করে।  ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন বলেছিলেন বস্তুগত সংস্কৃতি যেভাবে এগিয়ে যায় মানসিক বোধ-চেতনা সেভাবে পেছনে থাকে। ফলে যন্ত্র আর মনোবিকাশের মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান তৈরি করে।

বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মাথা চাড়া দেয় তেমন অসমতা থেকেই। সে সময় নজির হিসেবে খাড়া করা হয় জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ আবিষ্কার হলেও তা গ্রহণ করার মানসিকতার অভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা অসম্ভব। আমরাও অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে অবলোকন করি কিভাবে আধুনিক প্রযুক্তি সাবলীলতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সুষ্ঠুও সুস্থ মস্তিষ্কে গ্রহণ করার ব্যর্থতাই সমাজকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আজও একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়েও প্রযুক্তির বাংলাদেশে দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে বাল্যবিয়ে আজ অবধি অবোধ শিশু-কিশোরীদের সম্ভাবনাময় জীবনকে সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবাদ পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিয়ে রোধে তুমুল আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তেমন আন্দোলন আজও সফলতাকে স্পর্শ করতে না পারাও আধুনিক সময়ের চরম বিপর্যয়।

সে সময় নারী জাগরণের এই অবিস্মরণীয় পথিকৃৎ বলেছিলেন- বালিকাদের বিয়ের পিঁড়ি নয় বিদ্যালয়ে পাঠ হবে। তেমন প্রয়োজনীয় বার্তা আজও বাংলার ঘরে ঘরে না পাঠানো সত্যিই এক অসহনীয় দুর্বিপাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে প্রতি হাজারে ৭০ শিশু-কিশোরী অকাল মাতৃত্বের শিকার হচ্ছে। আরও ভয়ংকরভাবে উঠে আসে এক শিশুর গর্ভেই নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে।

বাল্যবিয়েকে আজও ঠেকানো সম্ভব না হওয়ার যথার্থ কারণ কি এবং কোথায় তা নির্ণয়ে কি গাফিলতি থেকে যাচ্ছে? দেশের আইনি কাঠামো ‘বাল্য বিয়ে নিরোধ আইনে’ বলা আছে ১৮ বছরের নিচে যে কোনো বিয়ে শিশু অথবা বাল্যবিয়ে হিসেবে চিহ্নিত হবে। শুধু তাই নয় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধও। কিন্তু এমন আইনের ব্যত্যয় দেশে যত্রতত্র। কোনো হিসাব নিকাশও নেই। ফি বছর পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদনে শুধুমাত্র উঠে আসে। কেউ আমলেও নেয় নাÑ শাস্তির বিধান তো দূর অস্ত।

প্রতিবেদনে শঙ্কাজনকভাবে উঠে আসে ২০১৮ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৪০ শতাংশে রূপ নেয়। এমন অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা দেশের উদীয়মান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। আর বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। প্রতিবেদনে আরও দুঃসহভাবে দেখানো হয় একটি শিশুর গর্ভে আর একটি শিশু বড় হচ্ছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে কোনো মেয়ের শরীর ও মানসিক অবস্থা মাতৃত্বের জন্য উপযোগীই নয়।

প্রস্তুতি নিতেও তারা অসহায় ও দুর্বল। শরীর-মন অবিচ্ছেদ্যভাবে তৈরি হওয়া শিশু-কিশোরীর জীবনের পালাক্রম। এর ব্যত্যয় কিশোরীটির জীবন যেমন বিপন্ন হয় আর তা জঠরে লালন করা। আর একটি অপরিপক্ব শিশু কোন অবস্থায় পৌঁছে তা ভাবা মুশকিল। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেছেন সবার আগে বাল্যবিয়ে রোধ করা অত্যাবশ্যক।  সেটা কোনো নীতি কথা, আইন কিংবা অর্জিত জ্ঞানে সম্ভব হয়। কোনো সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানেরও দায়বদ্ধতায় নয়।

বরং ব্যক্তি এবং পরিবার থেকেই তার সন্তানের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতায় কন্যা শিশুকে সব ধরনের নিরাপত্তার বেষ্টনী দেওয়া বিশেষ কর্তব্য। এমন চিত্র বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি করতে হবে। উন্নয়ন অভিগামিতায় বাল্যবিয়ে নিরোধ এক আবশ্যকীয় পূর্ব শর্ত। তার ব্যত্যয় আগত প্রজন্ম যথার্থভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হবে। সুস্থ নাগরিকই একটি সুন্দর জাতি উপহার দিতে পারে। সেখানে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা যায় একজন পরিণত সুস্থ মা-ই দেশের নতুন প্রজন্মের যথার্থ জন্মদাত্রী হবেন।

সে ক্ষেত্রে অবোধ কন্যা শিশুকে বই হাতে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। তা না হলে এমন আশঙ্কাজনক সমস্যা রোধ করা কঠিন হবে। অকাল মাতৃত্বের ঝুঁকি পড়বে গর্ভজাত সন্তানের ওপর। অপুষ্টি, ক্ষীণ স্বাস্থ্য আর হরেক রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষিত হওয়াও অধরা থেকে যাবে। 
অনেক শিশু কন্যার ঋতু¯্রাবের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা এক অযাচিত দুর্ভোগ। বর্তমান সরকার কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ করে প্রাথমিক-মাধ্যমিকে সমতাভিত্তিক কাঠামো হরেক কর্ম প্রকল্পে অব্যাহত রেখেছে। উপবৃত্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা গ্রামগঞ্জে অবারিত করে শুধু শিক্ষা নয়, নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যন্ত তেমন চিত্র স্বস্তিদায়ক হলেও পরবর্তীতে সেটা আর লাগামের মধ্যে থাকেই না।

প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকের যে সময়কাল সেখানে কন্যা শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ার দৃশ্য অস্বস্তিকর, দৃষ্টিকটু। বালিকারা করোনার আগ পর্যন্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিকে এগিয়ে গেলেও মহামারির চরম দুর্ভোগে সেখান থেকে বিচ্যুতি হতেও সময় লাগেনি। বর্তমানের গবেষণা প্রতিবেদন তারই ধারাবাহিকতার দৃশ্যমান নমুনা। বাংলার ঘরে ঘরে প্রত্যেক বাবা-মাকে এর বিরুদ্ধে সচেতন দায়বদ্ধতায় এগিয়ে আসতে হবে।

×