পর্যটন এলাকাগুলো
শুধু রাতযাপনের সুযোগ না থাকায় তিন দশকেও সমৃদ্ধ হয়নি শেরপুরের পর্যটনখাত। পর্যটকদের আগ্রহ থাকলেও লম্বা ছুটিতে গারো পাহাড় ভ্রমণে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আবাসিক হোটেলের অভাব। পুরো জেলায় গজনী অবকাশ, মধুটিলা ইকোপার্ক, পানিহাটা তাড়ানি, রাজার পাহাড়, অর্কিড পর্যটন প্রকল্প ও জিএস রাবার বাগানসহ বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র থাকলেও মাত্র একদিনের পরিকল্পনা নিয়ে শেরপুরে আসতে হচ্ছে পর্যটকদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য আবাসিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের ব্যবস্থা থাকলে আরও সমৃদ্ধ হতো শেরপুরের পর্যটনখাত। খাবার, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ভালো থাকলেও জেলা শহরের বাইরে নিরাপদ রাতযাপনের সুযোগ নেই শেরপুরে। শুধু পর্যটনকেন্দ্র নয়, শেরপুরের নালিতাবাড়িতে রয়েছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর। এই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাতায়াতের সুযোগ থাকলেও এখানেও নেই রাতযাপনের সুযোগ।
স্থানীয়রা বলছেন, আধুনিক ও সবধরনের সুযোগ সমৃদ্ধ রিসোর্ট ও আবাসিক হোটেল হলে পাল্টে যেতে পারে এখানকার চিত্র। এতে শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরের পর্যটকদের পদচারণায়ও মুখরিত হবে শেরপুরের সীমান্ত অঞ্চল। শেরপুরে রয়েছে ভারত সীমান্তঘেঁষা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শাল গজারির বন। রয়েছে উঁচু-নিচু টিলা ও পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। শত বছর ধরে বাস করা এখানকার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়েরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা। সীমান্তজুড়ে বিরাজ করছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি গারো পাহাড়। এ গারো পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগে দর্শনার্থীদের জন্য তিন দশক আগে গড়ে তোলা হয়েছে গজনী অবকাশ পর্যটনকেন্দ্র।
তথ্যমতে, তৎকালীন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নে ৯০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয় গজনী অবকাশ কেন্দ্র। এই পর্যটন কেন্দ্রের হাত ধরেই দেশজুড়ে শেরপুর জেলা পরিচিতি পায় ‘পর্যটনসমৃদ্ধ’ শেরপুর হিসেবে। যাত্রা শুরুর পর থেকে এক দশকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে শীত মৌসুমে অবসর যাপনের পছন্দের তালিকায় ঠাঁই করে নেয় গজনী অবকাশ। পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ বন বিভাগের উদ্যোগে নালিতাবাড়ীর মধুটিলা সীমান্তে ইকোপার্ক নির্মাণের পর শেরপুরের পর্যটন খাত গজনী অবকাশ ও ইকোপার্ককে কেন্দ্র করে সবার কাছে পরিচিতি পায়। সীমান্ত অঞ্চলে পিচঢালা প্রশস্ত সীমান্ত সড়ক পর্যটনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ওই সময় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। এতে মুখ ফিরিয়ে নেন পর্যটকরা। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে গজনী অবকাশে ঝুলন্ত ব্রিজ, ক্যাবল কার ও জিপ লাইনিংসহ বেশ কয়েকটি রাইড স্থাপনের ফলে আবারও পর্যটকের পদচারণা শুরু হয় গজনীতে। বনবিভাগের পক্ষ থেকেও মধুটিলা ইকোপার্ক ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সীমান্তের একই সড়ক ধরে রাজার পাহাড়, গজনী অবকাশ, রাবার বাগান, ইকোপার্ক, বারোমারি মিশন, নাকুগাঁও স্থলবন্দর, পানিহাটা তাড়ানিসহ ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য উপভোগের সুযোগ রয়েছে শেরপুরে। তবে একদিনে সবগুলোতে ভ্রমণের সুযোগ হয় না আগত দর্শনার্থীদের। আর রাত্রিযাপনের সুযোগ না থাকায় একদিনেই ফিরে যেতে হয় আগতদের। নিরাপত্তার জন্য বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টুরিস্ট পুলিশের দাবি দীর্ঘদিনের।
পর্যটকরা জানান, রাত্রিযাপনের সুব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার আগেই পর্যটন কেন্দ্র থেকে বের হতে হয় পর্যটকদের। এতে পাহাড়ি এলাকার রাতের সৌন্দর্য উপভোগ, বারবিকিউ ও সাংস্কৃতিক বিনোদনের সুযোগ থাকে না এখানে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ফরিদ বলেন, শুধু রাতে না থাকতে পেরে লম্বা সময়ের জন্য কেউ এখানে আসতে চান না। দুদিনের জন্য প্ল্যান করে এখানে আসতে পারলে শেরপুরের সবগুলো পর্যটন কেন্দ্র সময় নিয়ে উপভোগ করতে পারতেন সবাই।
রাজশাহী থেকে আসা দর্শনার্থী বলেন, ‘আমরা সাজেক, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় গেলে অন্তত তিনদিনের প্ল্যান নিয়ে যাই। ওই সব এলাকার চেয়েও সুন্দর পরিবেশ শেরপুরের এই সীমান্তে। খুব অল্প সময়ে অনেকগুলো স্পট এক্সপ্লোর করা যায়। কিন্তু রাতে থাকার জায়গা নেই। বাইরে ক্যাম্প করে তাঁবুতে থাকার সুযোগও দেওয়া হয় না। এজন্য অল্প সময়েই ফিরে যেতে হয়।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রেদুয়ান বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় এসে যদি রাতে বন্ধুরা মিলে বারবিকিউ না করতে পারি, তাহলে দুইশ কিলোমিটার জার্নি করে আসার মানে হয় না। কোনো রিসোর্ট থাকলে আমরা প্রোগ্রামও করতে পারতাম।’
সঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আল মাসুদ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, শেরপুরে ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এই গজনীর মাধ্যমেই সারাদেশে শেরপুর পরিচিত পেয়েছে। বেশ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে এখানে। তবে সময়ের সঙ্গে আরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি হোটেল-মোটেল হলে এখানে আরও পর্যটকের আগমন হবে।
এ বিষয়ে শেরপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির রুমান বলেন, পর্যটনের বিকাশে অবশ্যই রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা জরুরি। তবে আশার কথা হলো সাম্প্রতিক সময়ে শেরপুরের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ডের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও কমিউনিটি ট্যুরিজমের ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কর্মশালা করা হয়েছে। সম্প্রতি বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পর্যটন করপোরেশনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল গারো পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছে।
তখন সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলেন, শেরপুরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখানে একটি আধুনিকমানের পর্যটন মোটেল নির্মাণ করা হবে। শেরপুরের পর্যটনের বিকাশে জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচ একর জমির সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিদর্শন করা হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে। নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের বিষয় নিয়েও কাজ করা হচ্ছে।
এমএইচ