ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের তাগিদ

১০ মাসে ধর্ষণের শিকার ৬৪৩

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ২৮ নভেম্বর ২০২২

১০ মাসে ধর্ষণের শিকার ৬৪৩

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠান

নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা সারা বিশ্বেই উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন দিন। জীবনের নানা প্রতিক’লতা-প্রতিবন্ধকতরার পরও এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি লক্ষণীয়। কিন্তু তবু থেমে নেই নারীর প্রতি সংহিসতা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে নারীদের। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যা বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সারাদেশে ৩ হাজার ৬৭ জন নারী ও কন্যা শিশু বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৪৩ জন ধর্ষণ এবং ২০৫ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের শিশু আয়াতের উপর নির্যাতনের ঘটনা আতংকিত করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন, নারী নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত করা গেলে এসব নির্যাতনের ঘটনা কিছুটা হলেও কমবে। 

সোমবার ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’কে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলমান নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের ৪র্থ দিন রাজধানী ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে আয়োজিত জাতীয় কনভেনশনে এসব কথা বলেন নারী নেত্রীরা। ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধ করি, নতুন সমাজ নির্মাণ করি’-প্রতিপাদ্যর আলোকে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়োজনে এ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এদিন একটি নাচের মধ্য দিয়ে কনভেশন অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। কনভেনশনে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ. কে. রাশেদুল হক। ঘোষণা পাঠ করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

কনভেনশনে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় কমিটির সদস্য প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি-র ডিস্টিংগুইস ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন।  নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম সভাপতিত্বে কনভেনশনে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। 

এসময় সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন,  নারীরা সামষ্টিকভাবে সমাজের জন্য কাজ করছেন। তাদেরকে বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে হবে। জাতিগঠনের জন্য পরিবারের মাধ্যমে, পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যবোধ কিভাবে তৈরি করা যায় এবিষয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের শেকড় পরিবার, সমাজ ও সংসারকে শক্তিশালী করতে এর বিকল্প নেই। 

ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন,  নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে নানা পদক্ষেপ থাকলেও সহিংসতার কারণ, উৎস  বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে আলাদা । এর মূলে আছে সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে থাকা অসম ক্ষমতা।  আমাদের দেশে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আজকের আয়োজিত কনভেশনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

বিষয়ভিত্তিক আলোচনায়
সমাজ মানস ও নারীর মানবাধিকার বিষয়ে  জাতীয় কমিটির সদস্য প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, দেশের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা থাকলেও তার বিপরীতে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান চিত্র সমাজের নারী বিদ্বেষী মনোভাবকে প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় আলোচনায় বিজ্ঞান ভিত্তিক যা আলোচনা হয় তার চেয়ে বেশি থাকে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য। সমাজে একটা সহনশীল অবস্থা চলছে যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে, নারী পুরুষের বিভাজনে । এই পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি সকলকে সমাজ মানস পরিবর্তনে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। 

ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, গণপরিসরে ধর্ষণ বর্তমান সময়ের সামাজিক ব্যাধি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, নতুন সমাজ নির্মাণে একটি বৈষম্যমুক্ত ও পিতৃতন্ত্রমুক্ত আইনকাঠামো  তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত নারীবান্ধব আইনগুলোতে এখনো পিতৃতন্ত্রের ধারণা প্রবলভাবে রয়ে গেছে। প্রচলিত ধর্ষণের আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন আইন কাঠামো পরিবর্তন না করে ধর্ষণের সঠিক বিচার সম্ভব না। পাশাপাশি তিনি আরো বলেন নারী ও কন্যা নির্যাতনের  বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য তিনি মনিটরিং মেকানিজম নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।  

এসময় নারী ও কন্যার নিগ্রহ এবং সাইবার জগত বিষয়ে ড. কাবেরী গায়েন বলেন, প্রতি ১০ জনে একজন নারী সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সাইবার হ্যারাসমেন্টের বিষয়ে এখনো অনেক নারী জানেনা। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে তিনি এসময় আইনী প্রয়োগের উপর জোর দেন। 

নারী ও কন্যার মানবাধিকার ও অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নারীর প্রতি হয়রানি কখন নির্যাতনে পরিণত হয় তা এখন তরুণদের আলোচনায় আসছে। বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের কারণে নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। করোনায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে, ১০-২০% শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তারপর শিশুশ্রম বেড়েছে বাল্যবিয়ের পর বিচ্ছেদের কারণে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় বাড়লে নারীর প্রতি অভিঘাত বাড়বে। নতুন উন্নতির অংশীদারিত্বে নারীর অন্তর্ভূক্তি বৃদ্ধি না পেলে বৈষম্য বাড়বে। বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচির উন্নয়নে নারীর সাংস্কৃতিক, আইনী, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানে নজর দিতে গুরুত্বারোপ করেন।  তিনি আরো বলেন সংবিধানের ২৭ এবং ৪২ নং ধারা অনুযায়ী অভিন্ন পারিবারিক আইনে বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ ও দত্তক বিষয়কে কার্যকর করতে হলে সরকারকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। আজকের কনভেশনে উত্থাপিত সুপারিশসমূহ তুলে ধরে তার আলোকে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।  

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের  সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এস এম এ সবুর, লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ, সমাজকর্মী সালাউদ্দিন খান মঈনসহ এই জাতীয় কনভেনশনে সংগঠনের কেন্দ্র ও  ৪২ টি জেলা শাখার নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির নেতা, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। 

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ‘নারী ও কন্যার প্রতি যৌন নির্যাতন ও তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক আলোচনা ও গবেষণা প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এসময় ১৩টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র প্রতি মাসে গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রকাশিত তথ্য বলা হয় ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে।

নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে জানানো হয়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট তিন হাজার ৬৭ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪৩ জন নারী ধর্ষণ এবং ২০৫ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর আটজন আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া ১২৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা, ৩৩ জনকে শ্লীলতাহানি, ১১০ জনকে যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ১০৪ জনকে। এর মধ্যে ৭ জন উক্ত্যক্ত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।

এছাড়া চলতি বছর পাচার হয়েছে ১০৮ নারী ও কন্যা। এসিড দগ্ধ হয়েছেন ১৫ জন, অগ্নিদগ্ধ ১৩ জন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১০ জন, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৮ জন, যৌতুকের কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন। একইসঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮৮ নারী। আর পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০ নারী। 
 

স্বপ্না

সম্পর্কিত বিষয়:

×