পার্ল দ্বীপ
প্রথমবারের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপ মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে ইতিহাস গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কাতার। আর যারা এই খেলা দেখতে আসা অথবা দেশটিতে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের জন্য রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গ। তবে দেশটিতে ভ্রমণের সেরা সময় শীতকাল।
চলুন দেখে নেয়া যাক কাতারের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলো:
১. পার্ল দ্বীপ: প্রায় ৪ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত পার্ল মুলত বিলিয়ন ডলারের এক কৃত্রিম দ্বীপ। এটি পশ্চিম দোহার উপসাগরের উপহ্রদ থেকে ৩৫০ মিটার দূরে অবস্থিত, যার অবয়বটি মুক্তার রজ্জু সদৃশ। কাতারের ঐতিহাসিক মুক্তা সেঁচ ও বাণিজ্যের প্রতীকী স্বরুপ এরকম আকৃতি দেয়া হয়েছে।
পার্লের রয়েছে ১২টি এলাকা, যার প্রতিটি স্বতন্ত্র ভূমধ্যসাগরীয় বায়ুমণ্ডল সম্পন্ন। এখানে পাওয়া যাবে উপকূলবর্তী ভিলা, পথচারী-বান্ধব বাগান এবং আলফ্রেস্কো ক্যাফে। দ্বীপের সবচেয়ে জনপ্রিয় এলাকাটি হলো মেডিনা সেন্ট্রাল। এর বর্গাকার নৈসর্গে আছে পাম গাছের বুলেভার্ড, এবং ঝর্ণা ভবন। মনোরম কানাত কোয়ার্টিয়ার আরেকটি বিখ্যাত অংশ, যা ভেনিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আঁকাবাকা খাল, রঙিন ভিলা এবং খিলানযুক্ত সেতু দারুণ কিছু সময়ের জন্য পর্যটকদের লোভাতুর করে তোলে।
দ্বীপের পোর্টো আরব জায়গাটির স্থানীয় নাম মুক্তার হৃদয়। কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া এবং থাকার জন্য এটিই দ্বীপের সেরা জায়গা।
২. দোহার ইসলামী শিল্প যাদুঘর: চাইনিজ স্থপতি আইএম পেইয়ের নকশা করা ইসলামী শিল্প জাদুঘর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০০৮ সালে। কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত ভবনটিকে দূর থেকে একে অপরের উপরে রাখা কয়েকটি বাক্সের স্তুপের মতো দেখায়৷ এর ক্রিম রঙের চুনাপাথরের বাহ্যিক অংশটি ইউরোপীয়ান স্থাপত্যের আমেজ দেয়। পরিচ্ছন্ন জ্যামিতিক প্রান্তগুলো জানান দেয় এর মজবুত কাঠামোর কথা।
সূর্যের আলোতে ধারগুলো ঝলমল করতে থাকে। ভবনের উপরে চোখের মতো স্লিটটি বানানো হয়েছে ১৩ শতকের ওজুর ফোয়ারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যাদুঘরের কাছাকাছি হওয়ার জন্য লেকের উপর দিয়ে একটি সেতু অতিক্রম করতে হয়। বাইরের অবকাঠামোটি যতটাই সরল, এর অভ্যন্তর ভাগটি ঠিক ততটাই জটিল। এই বৈপরীত্য প্রতিটি দর্শনার্থীকেই হতবাক করে দেয়।
৩. দোহার সামরিক দুর্গ আল কুত: কাতারের এই ঐতিহাসিক দুর্গটি নির্মিত হয়েছে ১৯২৭ সালে, যাকে এক বাক্যে বলা যায় ভয়ঙ্কর সুন্দর। কয়েক যুগ ধরেই দুর্গটি যাদুঘর হিসেবে পর্যটকদের বিস্ময়ের খোরাক যোগাচ্ছে। এখনে রয়েছে পুরনো কাঠের সাজসজ্জা, প্রাচীন মাছ ধরার উপাদান, তেল চিত্র এবং পুরনো ফটোগ্রাফ। কাতারের ইতিহাস ও এর বাসিন্দাদের জীবনধারা বোঝার জন্য এই দুর্গের এক দিনের আতিথ্য গ্রহণ করাই যথেষ্ট।
এর শক্তিশালী বাইরের অংশটি মধ্যযুগীয় যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইউনেস্কো মনোনীত এই দুর্গে অনেক পর্যটকরা উটের পিঠে চড়ে আসেন। কেউবা জীপ ব্যবহার করেন। প্রধান প্রবেশদ্বারে দাড়িয়ে দুর্গের দিকে তাকাতেই দুর্গটি নিজের গল্প বলার জন্য যেন এক অমোঘ আকর্ষণে পর্যটকদের কাছে টানতে থাকে।
৪. খোর আল আদাইদ: কাতারের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত খোর আল আদাইদ মুলত চতুর্দিকে দ্বীপ ঘেরা বিশাল এক জলাধার। প্রায়শই একে সমুদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১২ কিলোমিটার চওড়া এই জলাশয়টি একটি গভীর এবং সরু ১০ কিলোমিটার চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যুক্ত হয়েছে পারস্য উপসাগরের সাথে। এখানে সাধারণত কোন পাবলিক যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। তাই জায়গাটি ঘুরার একমাত্র উপায় হল নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি।
খোর আল আদাইদ কচ্ছপ, গাজেল, অরিক্স, ডলফিন এবং বিপন্ন ডুগং সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়া অস্প্রেস, টার্ন্স, সিগাল সহ ফ্ল্যামিঙ্গো এবং হেরনের মত পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে এখানে। পর্যটকদের জন্য এখানে ব্যবস্থা আছে স্যান্ড স্কিইং, কোয়াড বাইকিং এবং উটের পিঠে চড়ার।
৫. সৌক ওয়াকিফ: দোহার সামাজিক কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত সৌক ওয়াকিফ কর্নিশ থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি এখানে সুযোগ আছে কেনাকাটা, সুস্বাদু খাবার খাওয়া; এমনকি আকর্ষণীয় স্থানীয় ক্যাফেগুলোতে অলস সময় পার করা যায়।
এর স্থাপত্য ও সূচিকর্ম, মশলা, সুগন্ধি, বাহারি ফল এবং আগারউড দিয়ে তৈরি চমৎকার ধূপ- ওউদ দেখার জন্য এখানে জড়ো হয় ভ্রমণপিপাসুরা। শিশা থেকে নির্গত ড্রুল-যোগ্য গন্ধ যখন সবেমাত্র তৈরি এলাচ চা কিংবা কাবাবের সাথে মিশে যায়, তখন তা যেন অমৃতের গন্ধ তৈরি করে।
৬. ফ্যালকন সৌক: সৌক ওয়াকিফের ঠিক পাশেই অবস্থিত এই সংগ্রহশালাটি শুধুমাত্র বাজপাখি সম্পর্কিত যাবতীয় সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো। এর বহিরঙ্গনে বাজপাখিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দেখা যায়। প্রশিক্ষিত হওয়ায় এই পাখিগুলোর একেকটির দাম একটি বিলাসবহুল গাড়ির চেয়েও বেশি।
বাজপাখি পালন ও তাদের প্রশিক্ষণ এখানকার স্থানীয়দের একটি ঐতিহ্যবাহী ক্রিয়াকলাপ। বাজপাখির হাসপাতালগুলো যে কোনো পাঁচ তারকা হাসপাতালকে টেক্কা দিতে সক্ষম। জগদ্বিখ্যাত ফ্যালকন ফেস্টিভ্যালের সময় দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শকরা হাতে বাজপাখি নিয়ে ছবিতে ফ্রেমবন্দি হন।
৭. ফুওয়াইরিত সৈকত: অত্যাশ্চর্য এবং নির্জন এই সমুদ্র সৈকত একটি আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য নিখুঁত পরিবেশ। দোহা থেকে ৯১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই সাদা বালির প্রশস্ত সৈকতে দর্শনার্থীরা কাঁচের নীল পানি এবং হাজার রঙিন ঝিনুকের উপকূলরেখা উপভোগ করতে পারে। অদূরেই সূক্ষ্ম বালির জায়গা দখল করা নুড়িগুলো পুরো সৈকতকে পাথুরে বানিয়ে ফেলেছে। চিত্তাকর্ষক চুনাপাথরের কাঠামোর প্রান্ত বিন্দু ধরে দর্শনার্থীদের চোখে পারস্য উপসাগর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর বালুকাময় উপসাগরগুলো পিকনিকের জন্য আদর্শ। তবে আশেপাশে কোন খাবারের দোকান না থাকায় এখানে আসার সময় ভালো ভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হবে। আরব উপসাগরীয় হক্সবিল কচ্ছপ এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে সমুদ্র সৈকতে তাদের ডিম পাড়ে। তাই এই মাসগুলোতে সমুদ্র সৈকত দর্শকদের জন্য বন্ধ থাকে।
৮. দোহার কর্নিশ: দৌড়বিদ অথবা সাইক্লিস্টদের জন্য প্রিয় জায়গা হতে পারে এই সমুদ্র তীরবর্তী স্থানটি। ১৯৭০ দশকের শেষ এবং ১৯৮০ দশকের শুরুতে দোহার উপকূলকে নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। দিনের বেলায় দোহার উপসাগরের স্বর্গীয় রঙ; সন্ধ্যায় চমৎকার সূর্যাস্ত; আর রাতে শান্ত পানিতে আলোকিত শহরের প্রতিফলন থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
দোহা উপসাগর বরাবর প্রসারিত ৭ কিলোমিটার জায়গাটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি নিয়ে আধুনিক স্থাপত্য এবং সবুজ স্থানগুলোকে ঘিরে রেখেছে। এই অত্যাশ্চর্য পথটি উপভোগ করতে যেয়ে স্থানীয় আল দাফনা পার্ক এবং জাতীয় শিল্প জাদুঘরের মতো চমৎকার স্থাপত্য কাঠামোর কথা অনেকেই ভুলে বসেন।
৯. দোহা মরুভূমি: কাতার ভ্রমণে মরুভূমি দেখা হবে না, তা হতেই পারে না। মনোরম সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হওয়ার জন্য এই অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপের বিশালতাই যথেষ্ট। তবে রোমাঞ্চকর মরুভূমি সাফারি উপভোগের সময় সিটবেল্ট বেধে নিতে ভুলে গেলে চলবে না। পাশাপাশি মানিয়ে নিতে হবে উটের ঝাকুনির সাথে।
মরুভূমির আবহাওয়া সাধারণত প্রতিকূল থাকে। এর ভেতর দিয়ে মাইলের পর মাইল আদিম ও চকচকে বালির সাগরকে উপভোগ করতে হলে সাথে রাখতে হবে উপযোগী কাপড়। সেই সাথে অধিক উত্তেজনায় শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় নেয়ার ব্যাপারে উদাসীন থাকা যাবে না।
১০. অ্যাসপায়ার পার্ক: অ্যাসপায়ার জোনে অবস্থিত এই পার্কটি ২১৭ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই সবুজ স্থানে ম্যানিকিউর করা লন, অপূর্ব পায়ে হাটা পথ, অ্যাসপায়ার ডোম, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, শপিং মল, শিশুদের খেলার মাঠ, সুন্দর ফোয়ারা, ক্যাফে এবং খাবারের জায়গা রয়েছে।
এখানে দেখা মিলবে বিখ্যাত আর্জেন্টাইন বাওবাব গাছের। পার্কের কেন্দ্রস্থলে দোহার একমাত্র হ্রদে প্রচণ্ড গরম থেকে আশ্রয় নিতে আসে বিভিন্ন ধরনের পাখি। পার্কের বাইরে ৫ কিলোমিটার রানিং ট্র্যাকটিতে সারা বছর ধরে দৌড়সহ শরীর চর্চার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পৃক্ত অসংখ্য ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। ৩০০ মিটার উচু আইকনিক অ্যাসপায়ার টাওয়ারটি রাতে আলোয় রাজকীয় হয়ে ওঠে।
এমএইচ