মহান বিদ্যাসাগরের জন্মের ৪৫ বছর পর এবং মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্মের ১৫ বছর আগে আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছিলেন আর এক বিস্ময়নারী। তিনি বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর একান্ত সঙ্গী লেডি অবলা বসু। স্বামী মি. বসুর পাশাপাশি, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনিও নিজের কর্ম জগতে বিচরণ করেছেন এবং নিজের বলয়ে তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য উজ্জ্বল। ক্ষণজন্মা এই নারী নিজের সমস্ত জীবনীশক্তি দিয়েই বুঝেছিলেন, নারী এবং শিশুদের জীবনের অন্ধকার দূর করার মধ্যেই নিহিত আছে, আমাদের সমাজ এবং জীবনের প্রাণশক্তি। বিদ্যাসাগর, অবলা বসু এবং বেগম রোকেয়াÑপ্রায় সমসাময়িক কালে জন্ম নেয়া এই তিনজন মহান মানুষ, ধারাবাহিকভাবে নারী এবং শিক্ষা সঙ্কট নিয়ে লড়াই করে গেছেন। তারা প্রত্যেকেই জন্মদায় হিসেবেই মনে হয় পেয়েছিলেন নারী লাঞ্ছনা দূর করার দায়ভার এবং নিজের নিজের ক্ষেত্রেও তারা ছিলেন সভ্যতার সফল কারিগর।
বিদ্যাসাগর কাল ১৮২০ সেপ্টেম্বর ২৬Ñ১৮৯৬ জুলাই ২৯, অবলা বসু কাল-১৮৬৫ ( মতান্তরে ১৮৬৪) আগস্ট ৮Ñ১৯৫১ আগস্ট ২৬, বেগম রোকেয়া কাল-১৮৮০ ডিসেম্বর ৯Ñ১৯৩২ ডিসেম্বর ৯। তাদের আবির্ভাব এবং কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হবে, এ যেন সভ্যতা নির্মাণের রিলে রেস। যেন একজনের অসমাপ্ত কাজ অন্যজনের পরম মমতায় বহন করে নিয়ে চলা। স্মরণ করা যেতে পারে, এই তিনজনই নারীর অবরুদ্ধ জীবন এবং শিক্ষা সঙ্কটকে দেখেছিলেন সামাজিক সঙ্কটের কেন্দ্র হিসেবে। অবলা বসুর আগে এবং পরে যে দু’জন নারীবান্ধব সৈনিক দেখা দিয়েছিলেন আমাদের এই ধরা ধামে, তারা যে নারী জাতির জন্য কতখানি যুধ্যমান ছিলেন, সেই গৌরবময় অতীত প্রতি মুহূর্তে আমাদের আজও রোমাঞ্চিত করে।
তবে আজ আমাদের আলোচনার কেন্দ্র হবে শ্রীমতী বসু। কথাটা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, বিদ্যাসাগরের পরে বাংলার নারী সমাজের মুক্তির দূত যদি অবলা বসুকেই বলা হয়, তবেই তাকে প্রকৃত সম্মান দেয়া হয়। কিন্তু কেন যে তাকে অতি যতেœ গ্রাম বাংলার নারী সমাজের কাছে অচেনা করে রাখা হয়েছে, তা ভেবে দেখবার বিষয় বা কেউ কেউ শুধু বিজ্ঞানী মি. বসুর সহধর্মিণী হিসেবেই তাকে দেখতে পছন্দ করেন। অথচ শ্রী বসু এবং তিনি ছিলেন পাশাপাশি চলমান দুই শক্তিধর মানুষ। বেগম রোকেয়া এবং অবলা বসুর মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র ১৫ বছরের। প্রায় সমসাময়িক সময়েই এই দুই দিকপাল ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নারী সমাজকে অন্ধকার মুক্ত করতে, নারী সমাজের শৃঙ্খল মুক্তির মহাযজ্ঞে। যখন মহীয়সী বেগম রোকেয়া এক হাতে বই-কলম এবং অন্য হাতে আলোর মশাল নিয়ে ছুটে চলেছেন বিরামহীন। তখন আলোকময়ী অবলা বসুও এক হাতে বই-কলম এবং অন্য হাতে আলোর মশাল হাতে সমান গতিতে ছুটে চলেছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। একের পর এক তিনি গড়ে তুলেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার সংখ্যা হবে দু’শ’র ওপরে। অবলা বসুর অসাধারণ এই কীর্তি আজও আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়। অবশ্য বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, এই সময় কাল পর্যন্ত আমাদের দেশে মহা জাগরণ উঠেছিল শিক্ষা এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের। সে আজ আমাদের কাছে শুধুই সুখ স্মৃতি। বিশেষ করে নারী মুক্তি আন্দোলনের গৌরবময় সেই ধারাবাহিকতার আজ নির্মম ছন্দ পতন যে ঘটেছে, তা আমরা জীবন দিয়ে প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করছি।
আমাদের দেশের নারীদেহ আজ প্রায় শিয়াল শকুনের খাদ্য এবং শিক্ষাকে পরিণত হয়েছে ধনী সমাজে বিলাসী সামগ্রীতে। একবিংশ শতাব্দীর অধিকার সচেতন এই যুগেও আমাদের বাল্যবিবাহের কাছে করতে হচ্ছে আত্মসমর্পণ এবং তা আইনসম্মতভাবে! আজও আমাদের দেশের মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে পিতৃ সম্পত্তি থেকে। অথচ ঠিক এর দেড় শ’ বছর আগে বাংলার আকাশে উদয় হয়েছিল অবলা বসু নামের উজ্জ্বল নক্ষত্রের। যিনি জীবনের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। কিন্তু আমরা, সেই অবলা বসুর স্বপ্নের দেশেই আজও হামাগুড়ি দিচ্ছি নিকষ কালো অন্ধকারে! এই দুঃখজনক রহস্যের উৎস কোথায়? তা অনেকটা গবেষণারই বিষয়! যাই হোক ফিরে আসি অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর পথযাত্রী অবলা বসুর কাছে।
বিক্রমপুরের বিখ্যাত দাশ পরিবারের সন্তান, নারী সমাজের পথিকৃৎ লেডি অবলা বসুর জন্ম ৮ আগস্ট ১৮৬৫ (মতান্তরে ১৮৬৪) বরিশালে। বাংলা ১২৭১ সালে। পদ্মার গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বিক্রমপুরের ছোট্ট গ্রাম তেলিরবাগের দুর্গামোহন দাশ, যিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অন্ধকার সমাজের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোসহীন যোদ্ধা। বহু বিবাহ বন্ধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন ও নারী শিক্ষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যোগ্য উত্তরসূরি। ব্রাহ্ম সমাজের মুখপাত্র এই দুর্গাদাশেরই কন্যা লেডি অবলা বসু। অবলা বসুর মাতা শ্রীমতী ব্রহ্মময়ী দাশ অবরুদ্ধ নারী সমাজের অন্ধকার ঘুচাতে, নিজের স্বকীয়তা নিয়ে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ছিল তার আপোসহীন পদচারণা।
শ্রীমতী বসুর ভাই তৎকালীন প্রখ্যাত অ্যাডভোকেট জেনারেল সতিশ রঞ্জন দাশ। বোন ‘গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের’ প্রতিষ্ঠাতা সরলা রায়।
গোপাল কৃষ্ণ গোখলে (গোখলে) এখানে কিছু আলোচনার দাবি রাখে। গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ছিলেন ভারতীয় হিসেবে কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি। তবে তার থেকেও তার বড় পরিচয়, তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি নিয়ে ১৯১০ সালে প্রথম সরব হয়েছিলেন। নারী সমাজকে তখন ১০ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হতো। মি. গোখলেই প্রথম নারীদের এই প্রাপ্ত বয়স নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। সম্ভবত সেই কারণেই, বিদুষী দুই বোন, তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারী এবং শিক্ষাবান্ধব মি. গোখলের নাম জড়িয়ে নেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং ভারতের পঞ্চম মুখ্য বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশ ছিলেন অবলা বসুদের নিকটাত্মীয়।
অবলা বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরিশালে। বরিশালেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন কলকাতার বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে বেথুন স্কুলে। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় এবং বেথুন স্কুলের তিনি ছিলেন প্রথম ছাত্রীদের অন্যতম। (চলবে)
শীর্ষ সংবাদ: