ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

লাইফস্টাইল বিভাগের সব খবর

কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই ॥ এ্যানি আক্তার

কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই ॥ এ্যানি আক্তার

কর্ম নেই। পরিবারে অসুস্থ স্বামী। দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি। ছয়জন সদস্য নিয়ে সংসার। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বামী প্রতিদিন স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট কর্ম করলেও বেশিরভাগ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেন না। ছোট ছোট সন্তানকে ভালো কিছু খাওয়াতেও পারেন না। শ্বশুর-শাশুড়িকে ভালোভাবে সেবা-যত্ন করাতে পারেন না। অভাব-অনটন সংসারে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবন পার করতে হচ্ছে এ্যানির। কথার শুরুতে করুণ শুরে কথাগুলো বললেন এ্যানি আক্তার। রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া যদু ফকিরপাড়ার বাসিন্দা এ্যানি। এইচএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা চালাতে না পারায় বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে হয়। স্বামী মুক্তার ফকিরের সংসারেও অভাব। অভাবের সঙ্গে যোগ হয় স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতা। অসুস্থ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন এ্যানি আক্তার। এভাবে বেশি দিন ঘরে বসে থাকেনিন এ্যানি। কর্মের সন্ধানে ঘর থেকে বের হন। গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করেন। পরে পরিবারের অভাব কিছুটা নিরসন হয়। তবে সেই জায়গায় থেমে নেই তিনি। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইউটিউিবে খোঁজ পায় মুড়ি ভাজা। মনোযোগ সহকারে দেখেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের গোয়ালন্দ উপজেলা কর্মকর্তা সালমা বেগমের সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। প্রথমে একটি মেশিন, একটি ঘর ও কিছু আমানত সংগ্রহ করেন। তারপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, স্থানীয় এনজিও থেকে টাকা সংগ্রহ করে মুড়ি ভাজা শুরু করেন। স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন মুড়ি ভাজা। তারপর বাজারজাত। এভাবে চলতে থাকে এ্যানির সংগ্রামী জীবন। মুড়ি বাজারজাত করার পর থেকে পেছনের দিকে আর তাকাতে হয়নি তাকে। গতি এখন সামনের দিকে। এ্যানি আক্তার বলেন, করুনা নয়। কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। লজ্জা করে ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওয়াতে আসবে না। তাই অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যতাকে দুর্বলতা না ভেবে বরং পুঁজি করে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে অনেক বাধা পেয়েছি। অনেকের বলতে শুনেছি নারীরা ঘরে থাকবে। সে কেন ঘর থেকে বের হবে। না, আমি পারি নাই। ক্ষুদার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকতে পারি নাই। তাই পেছনের মানুষের কথায় কান না দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি। এখন আমি সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত নিজের কর্মস্থানে কাজ করি। আমার কাজের সঙ্গী স্বামী এবং শাশুড়ি। পাশাপাশি আরও দুই কর্মচারী রয়েছে। মোট ৫ জন কাজ করি। নারী উদ্যোক্তা এ্যানি বলেন, এই মুড়ি স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির চুলায় ভাজা হয়। তবে একটি মেশিন শুধু মটরে ঘুরে। এতে চাল গরম করতে হয়। এর পর গ্রামীণ পদ্ধতিতে মাটির চুলায় লবণ মিশিয়ে মুড়ি ভাজা হয়। কোনো প্রকার কেমিক্যাল মেশানো হয় না। বাজারে চাহিদাও অনেক।   এ্যানি বলেন, এখন প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ’ কেজি মুড়ি ভাজতে পারি। বাজারজাতও করি। বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে টাকা নিতে পারলে করা সম্ভব হতো। কিন্ত যেখানে চাই, সেখানে কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সুতরাং ব্যাংক লোন নিতে পারি না। তবে আমি হতাশা নই। আমি আশাবাদী। এলাকার একাধিক নারী-পুরুষ বলেন, মুক্তারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বিয়ের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওর স্ত্রী এ্যানি কারও সহযোগিতা না নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন মুড়ি ভাজার কারখানা দিয়ে অনেক ভালো আছেন। ওর সাহসিকতা দেখে এখন অনেকে এগিয়ে আসছে। তবে প্রথমে আমরা এলাকাবাসী অনেক রকম কথা বলতাম। দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, আমার জানা ছিল না যে ইউনিয়ন পরিষদের পাশে একটি মুড়ি ভাজার কারখানা আছে। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। তিনি বলেন, আমি গর্বিত আমার ইউনিয়নের সাধারণ নারী-পুরুষ এখন ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সহযোগিতা লাগলে অবশ্যই আমি করব। গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, এ্যানি মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরামর্শ নিয়েছে। তিনি এখন ছোট্ট পরিসরে একটি কারখানা তৈরি করেছে। যেখানে পরিবারের সদস্যসহ ৫ জন কর্ম করছে। এই নারী উদ্যোক্তা এ্যানির সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি এ্যানির মতো অনেকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে না থেকে উদ্যোক্তা হবেন। মহিলা অধিদপ্তর সকলের পাশে থাকবে।   গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, আমি এই নারী উদ্যোক্তার কারখানা ঘুরে দেখেছি। সুন্দর পরিসরে এই নারী এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রকার সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, নারীরা এখন আর ঘরে বসে থাকে না। সব কর্মস্থানে নারীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে নেই। নারীরা কারও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে না। তারা আপন গতিতে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদের সকলের উচিত নারী উদ্যোক্তাদের অসম্মান না করে বরং সার্বিক সহযোগিতা করা। এতে গ্রামীণ নারীরা আরও ভালো করবে।

অপরিপক্ব নবজাতক

অপরিপক্ব নবজাতক

অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু। দুঃসহ বাতাবরণের করুণ আখ্যান। সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকেন গর্ভধারিণী মা। দেশে অকাল মাতৃত্বের নির্মম পরিণামও বহুবার আলোচিত এক অসহনীয় বিষয়। শিশু মৃত্যু ও মায়ের স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে একীভূত। সঙ্গত কারণে সবার আগে এসে যায় জন্মদাত্রী মায়ের জীবনাচরণ, সংস্কার, মূল্যবোধ আর প্রচলিত বিধি তো বটেই। যে সমাজে আজও বাল্যবিয়ে কমানো গেল না তেমন পশ্চাৎপদ কাঠামোর গভীরে জিইয়ে থাকে নানাবিধ অনাসৃষ্টিও। আর বাল্যবিয়ের অপরিণামদর্শিতায় ঠেকানোই যায় না অকাল মাতৃত্বের চরম প্রকোপও। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজের অবধারিত দুর্ভোগ। একজন শিশু কিংবা কিশোরী কন্যার বালিকা বয়সে বিয়ে হয় সেখানে ঘাত-প্রতিঘাত তো পদে পদে। পুতুল খেলার স্বাচ্ছন্দ্যময় বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পরিণামে যা হওয়ার তা ঠেকানোর উপায় না থাকাও আর এক অকাল বোধন বলাই যায়। নতুন সময় ও যুগের নব আঙ্গিক তো নয়ই। বহু যুগ ধরে চলে আসা এক চিরায়ত অপসংস্কারের প্রবল অপঘাত। শরীর ও মনের স্বাভাবিক পরিপক্বতা, মানসিক গড়ন, বোধ-বুদ্ধি জেগে ওঠা সবই এক সুতায় গাঁথামালা। অকাল মাতৃত্বে অপরিণত শিশু জন্ম আর এক দুর্বিষহ নাকাল সময়। যথা সময়ের আগে কন্যা শিশুর গর্ভে যখন আর একটা নতুন ভ্রƒণ তৈরির সম্ভাবনা থাকে মায়ের জন্য শুভ সংকেত তো নয়ই। নতুন প্রজন্মও মায়ের গর্ভে স্বস্তি আর নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠতেও হোঁচট খেতে হয়। এখানেই শেষ নয় কিন্তু। পরের সময়ও নিরাপত্তার বেষ্টনী বিঘ্নিত হলে মা-সন্তান উভয়েই পড়ে চরম বিপাকে। জন্ম যখন চরম দুঃসময়ের আবর্তে মৃত্যুও যেন হাতছানি দেওয়ার দুরবস্থায়। ‘বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উত্তরণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে আসে। বলা হচ্ছে দেশের ১৬ শতাংশ শিশুর জন্ম অকালে, শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্বতায়। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত কম ওজনের ৩ সদ্যভূমিষ্ঠ শিশু অসময়ে চলে যাওয়া পারিবারিক এক দুঃসহ পরিস্থিতি। প্রতিরোধ কিংবা চিকিৎসাহীনতা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সম্মুখ সমরে মা ও শিশুকে লড়াই করতে হয় বাঁচার তাগিদে। আইসিডিডিআরবি আর পিজির যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় মা ও সদ্যজাত শিশুর ওপর এক সময়োপযোগী কর্মশালা। গবেষক, বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসক ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে কর্মশালার বিরাট আয়োজনে মা ও শিশুর ওপর প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে। এমন সম্মিলন সভায় বলা হয় চিকিৎসা যা আছে তাও ব্যবহার হচ্ছে না। এটাই নিরেট বাস্তবতা। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় হরেক দিকনির্দেশনাও তুলে ধরা হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের অবস্থান, সময়, বেড়ে ওঠার পরিবর্তনও দর্শক-শ্রোতাদের অবহিত করা হয়। মাকে কততম সপ্তাহে অত্যন্ত সতর্ক, সাবধানতায় চলাফেরা করতে হয় তাও নির্দিষ্টভাবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ না হলে শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য অপরিপক্বই থাকে। গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শিশু মায়ের জঠরে নিরাপদ বেষ্টনীতে থাকার সময় মোট ৪০ সপ্তাহ। তার আগে জন্ম মা ও শিশুর জন্য অমঙ্গল ডেকে আনার দুর্বিপাক। একজন সুস্থ, সবল মা-ই পারেন দেশের আগামীর প্রজন্মকে সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখাতে। মায়ের স্বাস্থ্যই যদি বিপন্নতার আবর্তে পড়ে তা হলে গর্ভজাত সন্তানের নিরাপত্তার বলয় কোথায়? প্রশ্ন উঠতেই পারে। সঙ্গত কারণে অপরিণত শিশু ও মাতৃগর্ভ থেকে কিছু রোগ-বালাই নিয়ে আসে। শ^াসকষ্ট, জন্ডিস এবং রক্তস্বল্পতার আকালে পড়তেও সময় লাগে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে কম থাকা। যা সদ্যজাত শিশুর জন্য নিরাপদ কিংবা স্বস্তিদায়ক হয়ই না। ফলে সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ঝুঁকির আবর্তে পড়ে। বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার দুরবস্থাও ঠেকানো মুশকিল। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, মৃগি রোগ এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিকতার সমস্যাও মাথাচাড়া দেয়। সব মিলিয়ে শরীর যেমন আক্রান্ত থাকে পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পড়ে যায় নবজাতক। এমন শরীর ও মনের বিপন্নতা নিয়ে শিশু জন্ম হার নাকি বাংলাদেশেই বেশি। বিশে^র ১০৩টি দেশ নিয়ে করা গবেষণা তথ্যে এমন বিপন্ন চিত্র বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের অশনি সংকেত। শুধু কি তা-ই? সন্তান ভূমিষ্ঠ করা মায়ের স্বাস্থ্য অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। আর এমন কম ওজন আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নেওয়া নবজাতকরা পরিবার থেকে সার্বিক সামাজিক পরিসীমায় এক প্রকার আশঙ্কার মধ্যেই জীবন কাটানো সংশ্লিষ্টদের জন্য মারাত্মক দুরবস্থা। স্বাস্থ্য আর মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর এবং জীবন প্রবাহ। যাতে শুধু মা-শিশুই নয় পারিবারিক নির্মল আঙিনাও বেসামাল হতে সময় লাগে না। বিশে^র বিভিন্ন দেশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিপন্ন শিশুদের নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সুরক্ষা ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ রোগ-বালাই চিহ্নিত করে সমাধানের পথও নির্দেশ করা হয়েছে। এমন বিপন্ন নবজাতকের মধ্যে কন্যার চাইতে পুত্রের সংখ্যা বেশি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে বিশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নবজাতকের শারীরিক দৌর্বল্য ও মৃত্যু ঠেকানো যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। বিশেষ করে আপাতত দীর্ঘকাল চলে আসা কিছু অপসংস্কার দূর করতে পারলে সার্বিক না হোক আংশিক সমাধান বিপন্ন প্রতিবেশের ন্যায্যতা। বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, পরিবেশ দূষণ থেকে মা-শিশুকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসতে পারাও সময় ও আকাল পরিস্থিতির ন্যায্যতা। আর বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য ঝুঁঁকির বিপন্নতায় আক্রান্ত নবজাতকের জন্য দেশে সুচিকিৎসা আছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও যা আছে তাই দিয়ে নবজাতকের সযত্ন পরিচর্যা দরকার।

মায়ের পুষ্টিতে শিশুর স্বাস্থ্য

মায়ের পুষ্টিতে শিশুর স্বাস্থ্য

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল তাতে নানামাত্রিক অসমতাও দৃষ্টিকটু। সমাজের সমসংখ্যক নারীর জীবন ও স্বাস্থ্য সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্যময় এগিয়ে চলার নিয়ামক শক্তি। বিশ^ সৃষ্টির ঊষা লগ্ন থেকেই জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় ছিল আদিম বন্য দশার এক অভাবনীয় এগিয়ে চলা। অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিয়েতে পিতৃ পরিচয়ের সুযোগই ছিল না। মায়ের জঠর থেকে সন্তানের ভূমিষ্ঠ ইতিহাসের আর এক গৌরবোজ্জ্বল পালাক্রম তো বটেই। তাই পারিবারিক বলয় শুরু হওয়ার প্রারম্ভিক পর্যায় ছিল কাদের নিয়ে আদিম বন্য মানুষেরা পরিবার গঠন করবে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো আদিম গোষ্ঠী যখন পরিবার নামক সমাজ সংগঠনেরও ভিত্তি তৈরি করে সেখানে সবার আগে সামনে এসে যায় মাতৃত্বের অপার মহিমা। শুধু কি তাই? মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়াও ছিল আর এক অরুণোদয়ের অনন্য দীপ্তি। পিতৃ পরিচয় তখন অবধি সুদূর পরাহত। দলগতভাবে যে পরিবার আদিম সমাজে সংহতি তৈরি করে তা ছিল কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক আবহ। আগেই উল্লেখ করা হয় সন্তানের জন্মদাত্রী চিহ্নিত হলেও পিতার পরিচয় জানতে মানবগোষ্ঠী আরও অপেক্ষমাণ থাকতে হয়েছে। কোনো এক সময় একক বিবাহে মানবজাতি সংগঠিত হলে পিতার পরিচয়ও চলে আসে প্রশ্নাতীতভাবে। তাতে কি মায়ের মহিমার ক্ষুণ্ন্ন হয় কখনো? সেই আদি সমাজ থেকে আজ অবধি জঠরে ধারণ করে সন্তানকে লালন করা। কোনো এক শুভ মুহূর্তে পৃথিবীর আলো দেখানো মাতৃত্বের চিরস্থায়ী রূপ শৌর্যের আজ অবধি কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু সভ্যতার চরম উৎকর্ষে বিজ্ঞান যখন বিশ^কে নতুন আলোর কিরণছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন থেকে সমসংখ্যক নারীর জীবন অসমতা, বৈষম্য এবং নির্যাতনের চরম আকালে পরিণত হওয়াও সভ্যতা সূর্যের কালো দাগ। কিন্তু নারীর যে সফল ও মহিমান্বিত রূপ মাতৃত্বে তাতে সামান্যতম স্খলন না হওয়াও আধুনিক প্রযুক্তির আলোকিত পরিবেশের পরম নির্মাল্য। কিন্তু হরেক অসমতা আর দৃষ্টিকটু বিভাজনে নারীর যে অনাকাক্সিক্ষত পিছু হটা তাও সমাজ সভ্যতার অধোগতি। আধুনিকতার নতুন সময়েও বলা হচ্ছে সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তানের জন্য মায়ের বিকল্প অন্য কিছুই নয়। তা কিন্তু জঠরে লালন পালন করা থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা এক পর্যায়ক্রমিক এগিয়ে চলা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের নিবিড়তম ছোঁয়া ছাড়াও স্বাস্থ্যগত অবস্থারও পরম নিশানা। বলা হচ্ছে একজন সুস্থ মাই জাতিকে শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিয়ে পুরো গঠন প্রক্রিয়ায় যে অবারিত ভূমিকার দায়িত্ব পালন করে যায় তাও এক অমূল্য সম্পদ দেশের জন্য। সঙ্গত কারণে মাতৃস্বাস্থ্য ও নতুন সময়ের যুগ পরিক্রমায় এক অতি আবশ্যক সম্ভার, সম্বল তো বটেই। তবে দুর্বল ও রুগ্ন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যেমন নিজে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন তার চেয়ে বেশি সংকটাপন্ন হতে থাকে নতুন প্রজন্মের বিপন্ন শিশুটি। তাই মায়ের স্বাস্থ্যগত সচেতনতা আগামী প্রজন্মের নতুন জীবন গড়ার সবচেয়ে নিয়ামক শক্তি। সঙ্গত কারণে বৈষম্যহীন নতুন সরকার গঠন কার্যক্রমে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নজরদারিতে থাকা সময়ও পরিস্থিতির অনিবার্যতা। নারী সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা সময়ের যোদ্ধারা বলছেন নারী স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ সচেতনতা একান্ত জরুরিই শুধু নয় নবজাতকের প্রতি দায়বদ্ধতাও বটে। নারীর অপুষ্টিকে দূর করতে নতুন নীতিমালা ও কর্মসূচি অত্যাবশ্যক। যার জন্য পুরো ব্যবস্থাপনার নীতি ও কৌশল আধুনিক সময়ের প্রাপ্যতা। নারী নেত্রীরা আপত্তি তুলছেন এখনো সমাজের বৈষম্যমূলক পুরনো অপসংস্কারে সমসংখ্যক ভুক্তভোগী। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হচ্ছে দেশের সন্তানসম্ভবা মায়েদের অর্ধেকই রক্ত স্বল্পতায় আক্রান্ত। যা শিশু জন্ম থেকে আরম্ভ করে সার্বিক জীবনের এক করুণ অধ্যায়। আর এমন দুর্বিপাকের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে স্বাধীনতাহীনতা আর অধিকার আদায়ে ক্রমান্বয়ে পিছু হটা। আমরা এখনো সেই পারিবারিক বলয়ের চিরস্থায়ী সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিলে মিশে বাস করি। পরিবার এখনো সমাজের আদি ও অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। তাই মাতৃস্বাস্থ্যের সার্বিক দেখভালও ছোট্ট সংগঠন পরিবার থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয় এবং ন্যায্যতা। দেশের এখনো সিংহভাগ এলাকা গ্রামীণ পরিবেশে টিকে আছে। তাই পরিবার থেকেই নারী স্বাস্থ্যের বিশেষ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সার্বক্ষণিক কর্মযোগ অব্যাহত রাখাও জরুরি। একান্নবর্তী পরিবার হলে অন্যান্য সদস্যের দায়বদ্ধতা এসে যায়। গর্ভবতী মায়ের সেবা-যত্ন পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন সবই। গাফিলতিটা হয় কিন্তু সেখানেই। আর একক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর যে বন্ধন সেখানে স্বামী যদি সচেতন থাকেন অন্য কোনো ঝুঁকি কিংবা ঝামেলা অবকাশই থাকে না। গৃহিণী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের আয়োজন তো বটেই। কর্মজীবী অন্তঃসত্ত্বা মায়ের জন্যও জরুরি সব ধরনের প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থাপনার। পুষ্টিকর খাবার মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য এক অপরিহার্য বিষয় সেখানে গর্ভবতী মাকেও তার স্বাস্থ্য আর সন্তানের বিশেষ যত্ন আত্তির পালন করাও প্রতিদিনের অতি আবশ্যক কর্তব্য। সেখানে কোনো গাফিলতি কিংবা ঘাটতি মা ও আগত শিশুর স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বিচলিত হওয়ারই মতো। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ও নৈমিত্তিক এবং প্রাসঙ্গিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে একজন স্বাস্থ্যকর মাই একটি সুন্দর ও পরিচ্ছিন্ন জাতি উপহার দিয়ে দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিত করতে পারেন।

গ্রামীণ নারীর শিক্ষা

গ্রামীণ নারীর শিক্ষা

ব্রহ্মপুত্র নদের পারে চিলমারী উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ নদীভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এক সময়কার বড় গৃহস্থ নদী ভাঙনের স্বীকার হয়ে সব হারিয়ে হয়ে যায় শ্রমজীবী মানুষ। দুর্গম এ এলাকার মানুষ নানা অনিশ্চয়তার মাঝে তাদের সন্তানদের লালন-পালন করে। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। বাল্যবিয়ে এখনো হয় অনেক বেশি। দুর্গম চরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রাইমারী পাস করার পর মেয়ে শিশুদের বাড়িতেই থাকতে হয়। এক অনিশ্চয়তার মাঝে কাটে তাদের জীবন। এমতাবস্থায় তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকরা। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার মায়েরা তাদের কন্যা সন্তানদের সময় উপযোগী করে বাল্যবিয়ে দিতে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে ঐসব এলাকায় বেড়েছে মেয়ে শিশুর শিক্ষার হার। মেয়েরা মুক্তি পাচ্ছে বাল্যবিয়ের হাত থেকে। এমনি এক মা চিলমারীর রাজার ভিটার গ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের পারের গৃহবধূ লিপি বেগম। শুধু বাড়ির ভিটাটি ছাড়া আর কিছু নেই। এক বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হয়। তিন সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে লিপি বেগম। সংসারে উপার্জন করার কেউ না থাকায় বড় মেয়ে আঁখি তারার বিয়ের বয়স না হলেও গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনদের চাপে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাধা দেয় স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরডিআরএস। তাদের কর্মীবৃন্দ এগিয়ে আসে। লিপি বেগমকে বাল্যবিয়ের কুফল জানায়। সহায়তা করে ১৭ হাজার টাকা। তাই দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে শুরু করে দর্জির কাজ। তাকে ঐ সংস্থা প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে। লিপি বেগম সন্তানদের পড়াশোনা করার অঙ্গীকার করেন। সরে আসেন সন্তানের বাল্যবিয়ে থেকে। প্রতিদিন সেলাই মেশিন দিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে চলে তার জীবন আর সন্তানদের পড়াশোনা। পরে প্রকল্পের কর্মকর্তা ও মাঠ কর্মীদের পরামর্শে ছাগল পালন শুরু করেন। এতে দ্রুত সংসারের উন্নতি হতে থাকে। একদিকে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ ও অন্যদিকে ছাগল এবং হাঁস মুরগি পালনে আলোর মুখ দেখে লিপি বেগম। এক বছরের মধ্যে সংসারের অভাব অনটন দূর হতে শুরু করে। লিপি বেগম শান্তির ছায়ার এখন সুখের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। তিনি জানান, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাবেন। তারা যতদূর পড়াশোনা করতে চায়। তারা যেন দেশের মানুষের উপকার করতে পারে। এ স্বপ্ন দেখেন।  শুধু সে নয় রমনা খামার এলাকার শাহানা বেগমের চার সন্তান নিয়ে অভাবী সংসার। সংসারে টানাটানির কারণে অল্প বয়সেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং তৃতীয় মেয়ে মুক্তা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন পরে আর ডি আর এস  চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যম্যে বাল্যবিয়ের কুফল জানতে পারেন এবং তাদের দেওয়া ১৭ হাজার টাকা ও পরামর্শে ছাগল পালন ও সবজি চাষ শুরু করেন এবং সফলাতার মুখ দেখেন ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নৌকাও কিনে দেন। মেয়ে মুক্তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখন মুক্তা পড়াশোনা করছে। আর শাহানা বেগমের সংসারে সুখের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একই উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সরদারপাড়া গ্রামের বিধবা খাদেজা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রামবাসীর সহয়তায় বাড়িতেই কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনের চাপেও মেয়েকে  বাল্যবিয়ে থেকে বিরত রেখে পড়াশোনা চালাচ্ছেন। তিনি তাকে উচ্চশিক্ষিত করে শিক্ষক বানাতে চান। এমনিতেই চর এলাকায় শিক্ষিত মানুষের খুব অভাব। এখানকার শিশুরা অযত্নে অবহেলায় বড় হচ্ছে। তাই তার প্রত্যাশা তার সন্তান শিক্ষিত হয়ে এসব অবহেলিত শিশুদের পাশে যেন থাকে। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরডিআরএসের চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১৬২টি পরিবারকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সচ্ছলতা ফিরে এনেছে। এবং এসব পরিবারের মেয়েদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। এই প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ উপজেলা। এখানে বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ নদী ভাঙন ও দরিদ্রতা। লিপি, শাহানাদের মতো হাজারো পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্যবিয়ে না দেয়।