কর্ম নেই। পরিবারে অসুস্থ স্বামী। দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি। ছয়জন সদস্য নিয়ে সংসার। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বামী প্রতিদিন স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট কর্ম করলেও বেশিরভাগ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেন না। ছোট ছোট সন্তানকে ভালো কিছু খাওয়াতেও পারেন না। শ্বশুর-শাশুড়িকে ভালোভাবে সেবা-যত্ন করাতে পারেন না। অভাব-অনটন সংসারে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবন পার করতে হচ্ছে এ্যানির। কথার শুরুতে করুণ শুরে কথাগুলো বললেন এ্যানি আক্তার।
রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া যদু ফকিরপাড়ার বাসিন্দা এ্যানি। এইচএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা চালাতে না পারায় বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে হয়। স্বামী মুক্তার ফকিরের সংসারেও অভাব। অভাবের সঙ্গে যোগ হয় স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতা। অসুস্থ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন এ্যানি আক্তার। এভাবে বেশি দিন ঘরে বসে থাকেনিন এ্যানি। কর্মের সন্ধানে ঘর থেকে বের হন। গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করেন। পরে পরিবারের অভাব কিছুটা নিরসন হয়। তবে সেই জায়গায় থেমে নেই তিনি। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইউটিউিবে খোঁজ পায় মুড়ি ভাজা। মনোযোগ সহকারে দেখেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের গোয়ালন্দ উপজেলা কর্মকর্তা সালমা বেগমের সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন মুড়ি ভাজার কার্যক্রম।
প্রথমে একটি মেশিন, একটি ঘর ও কিছু আমানত সংগ্রহ করেন। তারপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, স্থানীয় এনজিও থেকে টাকা সংগ্রহ করে মুড়ি ভাজা শুরু করেন। স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন মুড়ি ভাজা। তারপর বাজারজাত। এভাবে চলতে থাকে এ্যানির সংগ্রামী জীবন। মুড়ি বাজারজাত করার পর থেকে পেছনের দিকে আর তাকাতে হয়নি তাকে। গতি এখন সামনের দিকে।
এ্যানি আক্তার বলেন, করুনা নয়। কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। লজ্জা করে ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওয়াতে আসবে না। তাই অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যতাকে দুর্বলতা না ভেবে বরং পুঁজি করে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে অনেক বাধা পেয়েছি। অনেকের বলতে শুনেছি নারীরা ঘরে থাকবে। সে কেন ঘর থেকে বের হবে। না, আমি পারি নাই। ক্ষুদার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকতে পারি নাই। তাই পেছনের মানুষের কথায় কান না দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি। এখন আমি সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত নিজের কর্মস্থানে কাজ করি। আমার কাজের সঙ্গী স্বামী এবং শাশুড়ি। পাশাপাশি আরও দুই কর্মচারী রয়েছে। মোট ৫ জন কাজ করি। নারী উদ্যোক্তা এ্যানি বলেন, এই মুড়ি স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির চুলায় ভাজা হয়। তবে একটি মেশিন শুধু মটরে ঘুরে। এতে চাল গরম করতে হয়। এর পর গ্রামীণ পদ্ধতিতে মাটির চুলায় লবণ মিশিয়ে মুড়ি ভাজা হয়। কোনো প্রকার কেমিক্যাল মেশানো হয় না। বাজারে চাহিদাও অনেক।
এ্যানি বলেন, এখন প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ’ কেজি মুড়ি ভাজতে পারি। বাজারজাতও করি। বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে টাকা নিতে পারলে করা সম্ভব হতো। কিন্ত যেখানে চাই, সেখানে কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সুতরাং ব্যাংক লোন নিতে পারি না। তবে আমি হতাশা নই। আমি আশাবাদী।
এলাকার একাধিক নারী-পুরুষ বলেন, মুক্তারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বিয়ের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওর স্ত্রী এ্যানি কারও সহযোগিতা না নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন মুড়ি ভাজার কারখানা দিয়ে অনেক ভালো আছেন। ওর সাহসিকতা দেখে এখন অনেকে এগিয়ে আসছে। তবে প্রথমে আমরা এলাকাবাসী অনেক রকম কথা বলতাম।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, আমার জানা ছিল না যে ইউনিয়ন পরিষদের পাশে একটি মুড়ি ভাজার কারখানা আছে। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। তিনি বলেন, আমি গর্বিত আমার ইউনিয়নের সাধারণ নারী-পুরুষ এখন ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সহযোগিতা লাগলে অবশ্যই আমি করব। গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, এ্যানি মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরামর্শ নিয়েছে। তিনি এখন ছোট্ট পরিসরে একটি কারখানা তৈরি করেছে। যেখানে পরিবারের সদস্যসহ ৫ জন কর্ম করছে। এই নারী উদ্যোক্তা এ্যানির সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি এ্যানির মতো অনেকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে না থেকে উদ্যোক্তা হবেন। মহিলা অধিদপ্তর সকলের পাশে থাকবে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, আমি এই নারী উদ্যোক্তার কারখানা ঘুরে দেখেছি। সুন্দর পরিসরে এই নারী এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রকার সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, নারীরা এখন আর ঘরে বসে থাকে না। সব কর্মস্থানে নারীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে নেই। নারীরা কারও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে না। তারা আপন গতিতে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদের সকলের উচিত নারী উদ্যোক্তাদের অসম্মান না করে বরং সার্বিক সহযোগিতা করা। এতে গ্রামীণ নারীরা আরও ভালো করবে।