
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাকরি আইন সংশোধন
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাকরি আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। সংশোধিত আইনে দাপ্তরিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কর্মচারীকে তদন্ত ছাড়াই মাত্র আটদিনের নোটিসে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। আইনটি সংশোধনের অনুরোধ জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন হবে। মূলত ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’-তে যা ছিল, সরকারি কর্মচারী আইনে তা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেটি বাতিল হয়েছিল ২০১৮ সালে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত খসড়ায় অভিযুক্ত কর্মচারীকে ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে অভিযোগের জবাব দিতে বা ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযোগের জবাব না দিলে বা জবাব দেওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপ করে তিনদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেবে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব, কিছু কর্মচারীর কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের রুমে হাতাহাতি,
সচিবের রুম আটকিয়ে আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এমন উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আইন সংশোধনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে বাতিল হয়ে যাওয়া ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’-তে যা ছিল, সরকারি কর্মচারী আইনে তা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের খসড়াটি প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন হবে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারাধীন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার বলেন, ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানটি অনেক কঠোর, কেউ কেউ কালো আইন বললেও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন চালাতে গেলে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। সরকার চাইলে চাকরিতে অনুপস্থিত কর্মচারীকে আটদিনের নোটিসে চাকরিচ্যুত করতে পারবে। এর জন্য পিএসসির মতামত বা তদন্তের প্রয়োজন হবে না।
সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের প্রস্তাবিত খসড়ায় তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, (ক) চাকরি থেকে বরখাস্ত, (খ) চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং (গ) পদাবনতি বা বেতন কমিয়ে দেওয়া। প্রথমত, কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে যুক্ত থাকেন যাতে অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় বা শৃঙ্খলা নষ্ট হয় বা অন্য কোনো কর্মচারীর কাজ করতে সমস্যা হয়।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কর্মচারী ছুটি বা অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা অন্য যে কোনোভাবে কাজ থেকে বিরত থাকেন। তৃতীয়ত, অন্য কোনো কর্মচারীকে কাজ থেকে বিরত থাকতে প্ররোচনা দেওয়া বা অন্য কোনো উপায়ে কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চেষ্টা করা। চতুর্থত, অন্য কোনো কর্মচারীকে তার কর্মস্থলে উপস্থিত হতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া। এর যে কোনো বিষয়ে দোষী কর্মচারীকে শাস্তি দিতে পারবে সরকার।
প্রস্তাবিত খসড়ায় অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচদিনের মধ্যে অভিযোগের জবাব দিতে বা ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে হবে। এ সময়ে অভিযোগের জবাব না দিলে বা জবাব দেওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপ করে তিনদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেবে। এর পর জবাব না দিলে বা জবাব দিলেও তা কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক না হলে অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর চূড়ান্তভাবে শাস্তি আরোপ করা হবে। তবে শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর সাতদিনের মধ্যে বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বরাবর ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে।
সূত্র জানায়, শাস্তির বিপরীতে আপিলের ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশে কোনো ‘আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না’- এমন বিধান ছিল। কিন্তু সরকারি কর্মচারী আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় এটা রাখা হচ্ছে না। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে আপিলের মাধ্যমে পাওয়া সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এমন আইন থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মচারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে আন্দোলনের নামে যে বিশৃঙ্খলা দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন।
ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, জনপ্রশাসনের অযোগ্যতা এবং দুর্বলতার জন্য প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরছে না। তাই সরকার হয়ত অন্য কোনো উপায় না দেখে এই নিবর্তনমূলক আইন ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। স্বাধীনতার পর জনপ্রশাসনে এত অযোগ্য নেতৃত্ব আর কখনো হয়ত ছিল না।
আইনে কঠোরতা ফিরলে বিগত সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের জন্য বিপদ হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ বিধানের উদ্দেশ্য কখনোই ভালো থাকে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এক যুগ্ম সচিবের মতে, এমন পদক্ষেপ কর্মচারীদের চিন্তার স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে, যা সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণœ করবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। এ কর্মকর্তা বলেন, ১৯৭৯ সালের বিশেষ আইনটি যখন হয়েছিল তখন সংবিধান স্থগিত ছিল। বর্তমান সরকার তো আইনের শাসনে বিশ্বাসী, তারপরও কেন কালো আইনকে পছন্দ করছে?
সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী বর্তমানে যে কোনো কর্মচারীর চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে সরকার। এর বাইরে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে ২০১৮ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি তদন্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
সরকারের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু সরকারি কর্মচারী যথাযথভাবে কাজে যোগ দেননি। এদের মধ্যে যাদের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান ও পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। যাদের চাকরি ২৫ বছর হয়নি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারায় কঠোর আইনের শূন্যতা অনুভব করছে সরকার। প্রসঙ্গত, ডিআইজি থেকে কনস্টেবল পর্যায়ের ১৮৭ পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাডার কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যথাযথ আইন না থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে কর্মচারীরা সরকারের নির্দেশ ঠিকমতো মানছেন না বা দায়িত্ব থেকে কৌশলে দূরে থাকছেন। সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলাহীনতায় সরকারি কাজের গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি ফেরানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আইনটির সংশোধন নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, সামরিক সরকার আমলের অধ্যাদেশকে ৪৫ বছর পর কার্যকর করা কতটা যৌক্তিক সরকারের ভেবে দেখা উচিত। এটি কর্মচারীদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে এমন আইন থাকা প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনে কর্মচারীদের জন্য প্রণীত প্রায় সবকটি আইন দুর্বল করা হয়েছে, যা কর্মচারীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ২৫ বছর পূর্ণ হলে যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে কারণ দর্শানো ছাড়াই বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে সরকার। কিন্তু এই বিধান খুব কমই ব্যবহার হয়।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু নিয়ম ভঙ্গকারী কর্মচারীদের জন্য এ আইনের প্রয়োগ হবে, ভালো কর্মচারীদের ভীত হওয়ার কারণ নেই।