
ছবিঃ সংগৃহীত
শিক্ষিত বেকারদের প্রায় সবারই অভিযোগ, একের পর এক চাকরির দরখাস্ত দিয়েও তারা সাক্ষাৎকারের ডাক পান না। এই অভিযোগের জবাবে চাকরিদাতারা বলছেন, বাছাই প্রক্রিয়াতেই বাদ পড়ে বেশির ভাগ আবেদনপত্র, কারণ এই আবেদনকারীরা নিজের জীবনবৃত্তান্তটাও নিজে লিখতে জানেন না। এদের অধিকাংশই পাড়ার কম্পিউটারের দোকান থেকে ভুলে ভরা, নিম্নমানের জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেন। এতেই বাদ পড়ে হাজারো চাকরিপ্রার্থীর আবেদন।
লাখ লাখ বেকারের দেশে যেকোনো পদের বিপরীতে জমা পড়ে হাজার হাজার আবেদনপত্র। স্কিল জবসের জরিপ বলছে, একজন নতুন চাকরিপ্রার্থী প্রতি ১০ থেকে ১৫টি আবেদনের বিপরীতে মাত্র এক থেকে দুটি সাক্ষাৎকারের ডাক পান। চাকরিবাজারে ঘোরা তরুণরা বলছেন, পড়াশোনার সময় তাদের চাকরি সংক্রান্ত কিছুই শেখানো হয় না।
একজন চাকরিপ্রার্থী বলেন, “আমি এ পর্যন্ত প্রায় ৭০টির বেশি সিভি জমা দিয়েছি, মাত্র তিনটিতে ভাইভাতে ডাক পেয়েছি। আমারই আপনার সাথে কথা বলতে একটু নার্ভাস ফিল হচ্ছে, ঠিক যেমন ইন্টারভিউ বোর্ডে হয়।”
আরও একজন বলেন, “স্কুল-কলেজে ওভাবে সিভি বানানো শেখানো হয়নি। Google থেকে নিজে নিজে সিভি বানানোটা শিখে পরে অ্যাপ্লাই করা হয়।”
তরুণরা কেন চাকরির আবেদনে সাড়া পান না—এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত জানতে চাইলে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড-এর চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, “প্রথমেই যে জিনিসটা ফেস করি, সেটা হচ্ছে, যে পজিশনের জন্য ইন্টারভিউ কল করা হচ্ছে, সিভি দিতে হবে—অন্তত অর্ধেক মানুষ এটা চিন্তা না করেই একটা সাধারণ সিভি সাবমিট করে দেন। তখনই সেটা ডিসকাউন্ট হয়ে যায়। প্রথম ইম্প্রেশন কিন্তু আমরা পাই আপনার সিভি থেকেই। ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনি বেশি সময় পাবেন না। ওই সময়ের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে কথা বলতে হবে, আর্টিকুলেট করতে হবে, কমিউনিকেট করতে হবে। ইন্টারভিউর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আসল কথা হচ্ছে, কিভাবে আপনি নিজেকে প্রেজেন্ট করবেন এবং কিভাবে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরবেন।”
কক্সবাজার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “তোমাদের মধ্যে অনেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেছ, কিন্তু জানো না কিভাবে সিভি ডেভেলপ করতে হয়। তোমার একাডেমিক রেকর্ডের সঙ্গে ক্যারিয়ারের যে একটা সংযোগ—সেটা রেপোর্টিং করে দেখাতে পারো না। এটাকে বাস্তবতার সাথে মেলানো, সেই সক্ষমতা তোমাদের নাই। ওই গাইডেন্সটা যেমন ক্যারিয়ার হাবে দেওয়া হয়।”
আবেদন লিখতে তারা এতটাই অনভিজ্ঞ যে অন্যেরটা কপি করতে গিয়ে বাবার নাম বা শখও কপি করে ফেলেন—বলছিলেন এক মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ।
ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেড-এর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ শামীম বলেন, “যে সিভি জমা দেওয়া হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবে তার নিজের না—এটা আরেকজনের সিভি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক জায়গায় দেখা গেছে নাম তার, কিন্তু বাবার নাম অন্য কারও। কারণ এটা কপি-পেস্ট করা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রায় ৯০% সিভি-ই কপি-পেস্ট করা।”
আবেদনপত্র লেখার দোকানগুলোতে কারা কিভাবে তরুণদের হয়ে আবেদন লিখছেন—তা জানতে গিয়ে জানা গেল, তাদের এখানে সব ধরনের সিভির ফরম্যাট রেডি আছে। যেই ফরম্যাট আছে, সেই অনুযায়ী তৈরি করে দেওয়া হয়। আবার কিছু শিক্ষার্থী বলেন, “ভাই, আমাদের এরকম একটা ফরম্যাট আছে, এই ফরম্যাটেই হবে কি না?”—সেই অনুযায়ী লিখে দেওয়া হয়।
যারা দোকান থেকে আবেদন লিখিয়ে নিতেন, তারাই এখন সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের যোগ্যতা কিভাবে তুলে ধরতে হয়, তা শিখে চাকরি পেয়েছেন—তাদের সাথেও কথা হয়েছে।
একজন বলেন, “আমি হতাশ হয়ে ২৫টির মতো চাকরিতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো কল আসত না। পরে ক্যারিয়ার হাবে চারদিনের যে ট্রেনিংটা হয়, সেখানে একটা দিন শুধু সিভি নিয়ে। ওখানে জানতে পেরেছি, অমুক জায়গায় কেন কল পাইনি, তমুক জায়গায় কেন পাইনি—এই জিনিসটা একেবারে ক্লিয়ার হয়েছে। এরপর আমি চারটি জায়গায় আবেদন করেছিলাম, দুইটি জায়গা থেকে কল পেয়েছি। জব সিলেক্ট করতেই কনফিউজ হয়ে গেছিলাম যে আমি কোন টাইপের জবে যাবো।”
আরও একজন বলেন, “আগে কম্পিউটার দোকান থেকে শুধু সিভিটা এনে দিতাম। কিন্তু জানতাম না, সেখানে আমার মনের কথা আছে কিনা। এখন আমি আর কম্পিউটার দোকানে যাই না। আমার সিভিতে আমি যা আছি, সেটা ফুটিয়ে তুলি। ক্যারিয়ার অবজেকটিভ সবসময় পরিবর্তন করি এবং আলাদাভাবে সেটাকে ফোকাস করি।”
চাকরিদাতারা বলছেন, নিজের সিভি বুঝে শুনে নিজেকেই লিখতে হবে। কারোটা কপি করলে প্রথমেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। সেই পজিশনটাকে চিন্তা করে যদি প্রয়োজন হয়, তবে নিজের সিভিকে একটু কাস্টমাইজ করতেই হবে।
ইমরান