ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা পড়তেন উমায়ের

প্রকাশিত: ১৯:০৭, ১৪ মার্চ ২০২৫

প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা পড়তেন উমায়ের

ঠাকুরগাঁওয়ের ছেলে এম এ উমায়ের ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও আইন না পাওয়ায় ভর্তি হয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। উভয় পরীক্ষায়ই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বাসার পাশে শুক নদে সাঁতার, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সামাজিক কর্মকাণ্ড, সংগঠন গড়ে তুলেই কেটেছে তার কৈশোর। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৭তম (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এম এ উমায়ের। ‘করোনা মহামারি আমাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। যেদিন দেখলাম ১৬তম জুডিশিয়ারিতে আমার বন্ধু প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই জজ হয়ে গিয়েছেন। অথচ আমি কী করছি! ছন্নছাড়া এক ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছি। সেদিন থেকে জীবন বদলানোর গল্প শুরু’- উমায়ের জানান।
উমায়েরের শুরুটা মোটেই সুখকর ছিল না। বিশ^বিদ্যালয় জীবনে প্রচুর ঘুরেছেন, আড্ডাবাজি আর খেলাধুলা করেই দিন কেটেছে। ডিপার্টমেন্টে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তা নিয়ে স্নাতকে ফার্স্ট ক্লাস তুলতে পেরেছেন। জুডিশিয়ারির পড়ালেখা শুরু করেন ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে। বন্ধুর প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই জজ হয়ে যাওয়া দেখে তিনি নিয়মিত পড়ালেখা শুরু করেন। প্রয়োজনীয় বই কেনা, নোট সংগ্রহ করা, জজ বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া- এসবই তখনকার রোজনামচা বলা চলে। প্রতিদিন তিনি ১০ ঘণ্টা করে টানা ৬ মাস পড়েছেন। তিনি প্রশ্ন-বিশ্লেষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১০ ঘণ্টা মধ্যে ২ ঘণ্টা বিগত বিজেএস ও বারের প্রশ্নব্যাংক বুঝার চেষ্টা করেছেন, ৩ ঘণ্টা নোট করেছেন আর ৪/৫ ঘণ্টা পড়েছেন। ঈদুল ফিতরের ২০ দিন পরে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছিল। এজন্য ঈদে বাড়িও যাননি তিনি, মেসেই থেকেছেন। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। উপলব্ধি করেছিলেন যান্ত্রিক এ শহরে প্রিয় মানুষ থাকা কতটা জরুরি!
উমায়ের বলেন, ‘লিখিত ও ভাইভার প্রস্তুতিতে পার্থক্য রয়েছে। তবে দুই ক্ষেত্রেই আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। জেনারেল সাবজেক্ট আপনাকে প্রিলিমিনারিতে টিকতে সহায়তা করবে, কিন্তু আইন আপনাকে জজ বানাবে। লিখিত পরীক্ষার ১০০০ এর মধ্যে আইনের ৬০০ নম্বর বেশ প্রভাব ফেলে। এখানে ৬০০ এর মধ্যে ৪০০ এবং জেনারেলে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান) ৪০০ এর মধ্যে ২০০ নিশ্চিত করতে পারলে আপনি একজন জজ হবার জন্য ভাইভা বোর্ডে হট ক্যান্ডিডেট। আমি এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে প্রস্তুতি নিয়েছি।’
বরাবর ভালো রেজাল্ট হওয়ায় বাবা-মায়ের অনেক বেশি আশা ছিল উমায়েরের প্রতি। মাঝখানে নিউরোলজিকাল সমস্যায় ভুগেছেন বেশ কিছুদিন। মা তাই বলতেন, ‘এত পড়িস না। চাকরি ২-৩ বছর পরে পেলেও চলবে।’ কিন্তু তার জেদ ছিল, কষ্ট করলে এক বছরই করব। টেবিলে পড়তে গিয়ে ঘাড় ব্যথায় বেডে শুয়ে শুয়ে পড়েছেন, তপ্ত গরমের দিনে ঢাকার মেসের ছাদে লাইট লাগিয়ে রাত ৩-৪টা পর্যন্ত পড়েছেন। কারণ আইনের বেসিক তার খুব দুর্বল ছিল। উমায়ের বলে, ‘মানসিক চাপ বরাবরই ছিল। পিছু হটার কথাও চিন্তা করেছিলাম। যখন টানা ৩টা অর্থোপেডিক্স ডাক্তার দেখানোর পরেও ঘাড় ব্যথা কমছিল না, তখন মনে হয়েছিল বাড়ি ফিরে যাই, বছর খানেক থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসি।’ এখন যখন সে সময়কার কথা মনে হয়- টানা ১০ দিন লিখিত পরীক্ষা, একদিন পরীক্ষা থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভেজার স্মৃতি, ভিকারুননিসা স্কুলে বাইরের ফুটপাতে বসে ৩০০/৪০০ জন মানুষ পরীক্ষার আগে ঘণ্টাখানেক একই বিষয় পড়া- এ সবই এখন মধুর স্মৃতি হিসেবে তার মনে উঁকি দেয়।
যারা আইন নিয়ে পড়তে চান তাদের উদ্দেশ্যে উমায়েরের পরামর্শ, ‘যারা অনার্স পড়াকালীন বিজেএস প্রস্তুতি নিতে চাচ্ছেন, তাদের বলব চাপ নেবেন না। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখুন। একটু একটু করে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করুন। অন্যদিকে যারা আমার মতো অনার্সে তেমন পড়েননি, স্বল্পসময়ে স্বপ্নের চাকরিটি পেতে চাচ্ছেন, প্লিজ টানা ৬-৯ মাস প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে লেগে থাকুন। শেষ হাসি আপনি পকেটে নিয়েই বাসায় ফিরবেন। আর যারা ৪-৫ বার প্রিলি, রিটেন, ভাইভা দিয়েও সফল হতে পারছেন না, তাদের এতটুকু বলব আপনারা ধৈর্য ধরে এগিয়ে যান, সৃষ্টিকর্তা হয়তো আরও ভালো কিছু চিন্তা করেছেন আপনাদের জন্য। শেষ কথা বলতে, পড়ালেখার প্রতি সৎ থাকুন ও কৌশল সাজান, কারণ এটা কখনো আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।’
 চাকরি বাজার ডেস্ক

×