ইশরাত জাহান অনন্যা
কলেজে পড়ার সময় বিএনসিসিতে যোগ দেন ইশরাত জাহান অনন্যা। স্বপ্ন দেখতেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কিন্তু বাবার অনুমতি পাওয়া গেল না। পরবর্তীতে সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা হয়। কিন্তু ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করার সময় ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা বাদ দেন। ভ্রমণপিপাসু অনন্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ভ্রমণ সংগঠন ডিইউটিএসের সদস্য হয়ে গেলেন। বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ২০১৭-২০১৯ এর মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোসহ ৪৬টি জেলা ঘুরে শেষ করেন। একটামাত্র টিউশন পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ বহন করতেন। করোনাকালে সব জায়গায় চলাচল সীমিত হওয়ায় আর নিজের অসুস্থতার কারণে বাঁধা পড়ে যায়। বাকি ১৮টি জেলা চাকরি পাওয়ার পর সম্পন্ন করেন।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে কোরিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষায় জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্স এবং কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট থেকে চাইনিজ লেভেল ওয়ান পাস করেছিলাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজক ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার জন্য ‘দ্য ডিউক অব এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর ব্রোঞ্জ, সিলভার ও গোল্ড তিনটি অ্যাওয়ার্ডই পেয়েছি’Ñ জানান অনন্যা।
২০১৮তে বিবিএ শেষ করেই ইন্টার্নশিপের জন্য খোঁজ পান নতুন ব্যাংক ‘সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক পিএলসি। অনন্যা বলেন, ‘আমার ডিপার্টমেন্টে জানানোর পর কো-অর্ডিনেটর চিঠি পাঠান ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে। ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে ইন্টার্নশিপের জন্য আমাকে পাঠানো হয়। সেখানে সবাই খুব সহযোগিতা করেছেন কাজ শেখানোর ব্যাপারে।’
এরপর এমবিএ করার পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পড়তে গিয়ে বুঝতে পারেন বিসিএস, ব্যাংক আর পাওয়ার সেক্টরের জন্য প্রস্তুতিতে কিছুটা তফাত রয়েছে। বিসিএসের পড়াশোনার সিলেবাস বেশ বড়। নিয়োগ প্রক্রিয়াও দীর্ঘ, ধৈর্যশীল মানুষ ছাড়া এখানে টিকে থাকাও মুশকিল। অনন্যা তখন বেছে নিলেন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয়ত ব্যাংক। এমবিএ পাস করে বেশকিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। একদিন চোখে পড়ল ইন্টার্নশিপ করা সেই প্রতিষ্ঠান ‘এসবিএসি ব্যাংক পিএলসি’র এমটিও পোস্টের জন্য সার্কুলার দিয়েছে। আবেদন করলেন অনন্যা।
ইশরাত জাহান অনন্যা জানান- ‘পুরোদমে চাকরির পড়া শুরু করি ২০২০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে। আমার পড়াশোনায় একটা ভিত তৈরির পেছনে আমার বাবা ও ছোট ভাইয়ের অবদান অনেক। বড় ভাই, আম্মু আর আমার স্বামী দিয়ে গিয়েছেন মানসিক সাপোর্ট। আমি এদেরকে লাকি চার্ম বলি! প্রচন্ড মাইগ্রেন নিয়ে সকালে সাভার থেকে ঢাকায় এসে একটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সেদিন বিকেলেই ছিল এসবিএসি ব্যাংকের পরীক্ষা। ভাইভা হয়েছিল সন্ধ্যা ৭টার পর। ২০২২ সালের ৮ মে আমি এসবিএসি ব্যাংক পিএলসিএ ‘ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার’ হিসেবে যোগদান করলাম। প্রাথমিকভাবে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে শর্টলিস্ট করা হয়। ব্যাংকের অফিসার হতে চাইলে তাকে আইবিএ বেইজড সিলেবাস শেষ করতে হবে। এ জন্য দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা হয়। প্রথম এক ঘণ্টায় প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রায় ৭০ নম্বরের জন্য উত্তর দিতে হয়। পরের আধা ঘণ্টায় লিখিত অংশ। প্রিলিমিনারিতে এমসিকিউ গণিত, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, আইসিটি ও মানসিক দক্ষতা থেকে প্রশ্ন করা হয়। প্রিলিমিনারিতে পাস করতে পারলেই তবে লিখিত অংশের খাতা দেখা হয়। এই দুই অংশে যারা কাক্সিক্ষত নম্বর অর্জন করতে পারেন, তাদেরই পরবর্তীতে ভাইভার জন্য ডাকা হয়।
গণিত থেকে যেহেতু প্রশ্ন বেশি থাকে, গণিতের ওপর বেশ ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। আমি আইবিএ- এর নেওয়া সকল পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান করে, যেসব অধ্যায়ের ওপর বেশি প্রশ্ন আসত, সেগুলোর অনুশীলন বেশি করেছিলাম। আর ইংরেজি এবং আইসিটি যেহেতু একদমই মৌলিক তথ্যগুলো থেকে আসে, তাই সেই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা জরুরি। যে কোনো এক সেট বই থেকে ইংরেজির সব বেসিক নিয়মকানুন, ভোকাবুলারি পড়েছিলাম। অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন মডেল টেস্ট ও প্রশ্নের সমাধানের মাধ্যমে উত্তর সঠিক করার নিশ্চয়তা বাড়ানো যায়। সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নগুলো ছিল সাম্প্রতিককালের। তাই সমসাময়িক ঘটে যাওয়া দেশের এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। সে জন্য প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও পেপার নিয়মিত পড়তাম। লিখিত অংশে ফ্রি হ্যান্ড রাইটিংয়ের অংশ হিসেবে একটি অনুচ্ছেদ লিখন এসেছিল। এ ছাড়া দুটি সাধারণ গণিতের সমাধান ও কিছু শর্ট নোটস আসে। লিখে পড়ার অভ্যাসটা আমার এই ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে।’
ভাইভার জন্য অনন্যা পড়েছিলেন ব্যাংক এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন। ভাইভা বোর্ডে সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের সবাই থাকেন। প্রথমে সেখানে নিজের পরিচিতি জানতে চাওয়া হয়। অনন্যা বলেন, ‘একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি এর আগে কোথাও চাকরি করেছি কিনা, ফ্রিল্যান্সিং এ আমার আয় কেমন হয়, কেন ব্যাংকে যোগদান করতে চাচ্ছি, আমার লক্ষ্য কি? আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন ব্যাংকিং মানে কি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কি, দেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার কত ইত্যাদি। অন্য একজন প্রশ্ন করলেন আপনি যখন ফিন্যান্সে পড়ছেন বলুন তো ইনভেস্টমেন্ট কয় ধরনের হয়? উত্তর দেওয়ার পর উনি আরও জানতে চাইলেন বাংলাদেশে ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট কত ধরনের, কোন মার্কেটের রেগুলেটর কারা, কনটিনজেন্ট লায়াবিলিটি কি ইত্যাদি। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।’ এক বছরের মাথায় পদোন্নতি হয়ে অনন্যা এখন ‘সিনিয়র অফিসার’ হিসেবে কাজ করছেন। অনন্যার সুন্দর সাফল্য কামনা করছি।