হৃদয়প্রণীতজোছনা ওড়ে মাতামুহুরিজলে
‘হৃদয়প্রণীতজোছনা ওড়ে মাতামুহুরিজলে’ বইমেলা-২০২৪ এ পু-্রু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থে মোট ৪৪টি কবিতা মুদ্রিত হয়েছে। কবিতার ঘোরের ভেতর স্থির সময়ের অস্থির ভাবনা হতে চোখের অন্ধকার আলোয় লুকিয়ে আছে। সেই ঘোর থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে একটি কচিপাতা, মুহুর্তের রঙ, হলুদ থেকে কালচে সাদা আবার সাদা থেকে কী এক রঙ- বুঝে ওঠা যায় না। শুধু কবির ভাবনায় দেখা যায়Ñ অন্ধকার সরে আসছে- চোখের কালো দাগগুলো মুছে যাচ্ছে আগের অবস্থানে।
যেখানে কবি হলুদ ফিকে রঙ মিশিয়ে গুলতি অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরে শব্দের উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। কবির কবিতায় মানবিক বিপর্যয়, অস্তিত্ব সংকট, সমাজ-জাতি ইত্যাদি অনুষঙ্গ বিষয় করে কবিতা ফুটে উঠেছে। বিদেহী শব্দের আত্মা, শব্দের জান্তব লাশ স্বরে-বিস্বরে স্বাধীন হবার ব্যাকুলতায় অন্তিম ইচ্ছেরা ঘুমুতে দিচ্ছে না কবিকে নিবিড় শূন্যতায়।
তার কবিতাপাঠে আমরা মনের এক বিশার ব্রহ্মা পার হতে হতে কবির অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে রূপান্তরিত করছি এক চিন্তাবিশ্বের মনোট্রেনের যাত্রী হিসেবে। আলোচনার সঙ্গতি রক্ষার্থে আমরা কবির কবিতা পড়িÑ‘সমুদ্রশিয়র থেকে চোখের সূর্যে ভোর হলো আশ্রয় স্বপ্নের.../ সব বোঝার আশ্চর্য কেমিস্ট্রির অন্তর্গহনে আর স্বরচিত মনন স্বাচ্ছন্দ্যে ছেড়ে দিলাম তোমাকে, বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে!
বিরহমান এইজলে সর্বত্রই অমিত লাবণ্যমেঘ/এখন বড় হয়ে ওঠা দূরগামী দৃশ্যরা জেনে নিক আমাদের মেজাজি কাব্যভাষা অধুনাচিন্তার কথোপকথন (দূরগামী দৃশ্যের কথোপকথন, পৃ-১১) কবির এই কবিতায় পাঠক দৃশ্যের ভেতর অর্ন্তগত হয় এক অলৌকিক চেতনায়। আবার-‘বেদনার চোরাবালিতে পা রাখবো না ভেবে/ কতো সময় কেটে গেলো জীবননদীতেÑ/জানিÑ তবুও পৃথিবী একদিন ঘুড়ে দাঁড়াবেÑ/ আমরা বহিরাবরণ বেঁচে থাকবো কোনো এক ¯œানঘরের বেদনার সমুদ্রে (¯œানঘর, পৃ-১৪) কবি প্রেম ভালোবাসা আর আশ্রয় খোঁজেন প্রিয়জনের অনুভূতিতে-‘অনাকাক্সিক্ষতভাবে একদিন সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমাদের দেখা হলো../ তোমার চোখে-মুখে আর হৃদয়ের বসতবাড়িতে আমার কতোখানি জায়গা! আমার বিশ্বাসের ঠিকানা তুমি আর আমি তোমার হৃদয়প্রণীতজোছনা জীবনের মধুময় আলো!’ (প্রথম অনুভূমি, পৃষ্ঠা-২০) কবিতা কিন্তু অন্তরের মস্তিষ্কে উপাদানে বিভিন্ন চেতনায় ধর্মান্তরিত হয়। কবির চিন্তাগুলো অর্থবহ প্রেরণায় অন্তরবিহ্বল অনুভূতিতে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে অন্যভাষায় অন্য ট্রান্সমিশনে।
কবি যখন বলেনÑ‘জীবনের দীর্ঘপথ হেঁটে এসে ইশারা ঝড় প্রসঙ্গ বদলে দিলো/অমীমাংসিত ধারণার বাতাস, (বিবর্তনের নিদ্রা ভেঙে, পৃ-১৯) আবার-‘মলিন দিগন্তÑ ফুঁপিয়ে উড়ছে আকাশে মাতাল সময়েÑ (ছল-চাতুরীর করতলরেখা, পৃ-৩৪) বিশসংস্কৃতিতে যেসব শতাব্দী-উচ্চ ঢেউ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বেলাভূমিতে নতুন ঢেউ দোলা দিচ্ছে, নাড়িয়ে দিচ্ছে লুৎফা শাহিনের কবিতা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মার্জিত দুরূহ শব্দ এবং জীবনানন্দ দাশের তীব্র জটিলতর ভাবনার ব্যঞ্জনা শাহিনের কবিতায় নেইÑ বরং অন্তর্গহনে আছে শরীর আর আত্মার অভিনব কেমিস্ট্রি।
এই কবি এ সময়ের কবিতা লেখেন, পুনরাধুনিক কবিতার ফর্ম আর দ্যোতনায় রচনা করছেন কবিতাবলি। লক্ষ্য করা যায় কবি ভাষা-শব্দকে আরোপিত করেননি, বরং নিজ ভাষা ও শব্দে ভর করে নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে পোঁছতে চান পাঠকের কাছে।
‘বোধের সব উন্মুখ জানালা খুলে রেখেছি আকাশে’ (নির্ভরতার চন্দ্রোৎসব, পৃ-৪২) এরকম দৃঢ়তাসম্পন্ন বাক্য অন্তরের সহজিয়া প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। আমরা কবির সিগনেচার নিশ্চিত করতে তার গ্রন্থশিরোনামযুক্ত কবিতাটি কিছুটা তুলে ধরিÑ ‘পাখিরা এঁকেছে আকাশের মুক্ত তারার সোহাগিরোদ,
সোনালিধানের শীষের দোলায়িত ধু-ধু বালুচর, রক্তাক্ত কুয়াশায় ঢাকা দূর্বাঘাসের পাড় নদীর কিনার কিংবা জলের ঈশ্বররিমিথ।
..হাজার দুয়ারির ফেলে আসা স্মৃতির বাগানে ময়ূরপঙ্খির মতো নৃত্যে খেলা করে মাতামুহুরির বালুচর..মাতামুহুরি আমাদের যৌবনমত্ত প্রাণের চোখে আঁকা অনাতিকালের ইতিহাস..অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির তীরে মাতামুহুরি ছড়িয়ে আছে প্রিয় চকোরিয়ার অনিন্দ্য জীবন প্রচ্ছদেÑ’ভালোবাসা আর সৌন্দর্যবোধ আমাদের পরিশীলিত করুক যাপনের কৃষ্ণ বুকের চাতালে! কবি লুৎফা শাহিন সবার হৃদয়ে জোছনা উড়িয়ে পাঠকপ্রিয়তাকে ছুঁয়ে যাবে এই শিহরন প্রত্যয় রাখা যেতেই পারে।