ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১

নিসর্গের প্লাবনে ভাসব অন্তহীন লাশ

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ২২:১৪, ২৭ জুন ২০২৪

নিসর্গের প্লাবনে ভাসব অন্তহীন লাশ

অসীম সাহা

‘এই প্রকৃতি একদিন আমাদের গ্রাস করবে
জিরাফের মতো গ্রীবা বাড়িয়ে অকস্মাৎ,
কাঁঠালিচাপার বন, এই জ্যোৎস্নারাত
অমলিন নিসর্গের শোভা হানাদার দস্যুর মতো
ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসবে
আমাদের দিকে, অবরোধ করবে ঘরবাড়ি, শস্যের গোলা
খাদ্যভাণ্ডার লুট করে নিয়ে যাবে আমাদের মুখের গ্রাস ...............
এই আক্রমণকারী প্রকৃতির হাতে
একে একে ধ্বংস হবো আমরা
শিশু, বৃদ্ধ, যুবা
নিসর্গের প্লাবনে ভাসবো অন্তহীন লাশ!
(নিসর্গের খুন- অসীম সাহা)। 

প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এমন অসাধারণ কবিতা লিখেছেন যিনি তিনি অসীম সাহা। কবি অসীম সাহার পিতৃভূমি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার তেওতা গ্রাম। জন্মগ্রহণ করেছিলেন নেত্রকোনা জেলার মামাবাড়িতে ১৯৪৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি। পিতার চাকরিসূত্রে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন মাদারীপুরে। তার পিতা ছিলেন নাজিমউদ্দিন কলেজের (অধুনা মাদারীপুর সরকারি কলেজ) অধ্যক্ষ, ‘সংখ্যা দর্শন ও ন্যায় দর্শন’ গ্রন্থের প্রণেতা, প্রখ্যাত দার্শনিক অখিলবন্ধু সাহা। লেখক পিতার সান্নিধ্যেই লেখালেখির শুরু।

১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করার পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শরণার্থী শিবিরের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে ঘিরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে শাহবাগে, কাঁটাবনে, হাতিরপুলে, ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে, নীলক্ষেতে এবং বাংলা একাডেমিতে। তাঁকে বেশিরভাগ সময় বইয়ের দোকানে বা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানের মঞ্চে বা দর্শকসারিতে। এভাবেই কেটেছে তার জীবনের প্রায় ছয়টি দশক।

প্রিয় কবি অসীম সাহা ১৮/০৬/২০২৪ তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন প্রবন্ধ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ নিবন্ধ কবিতা ছড়া আর গান মিলিয়ে মূল্যবান একটি বই। তিনি অনুবাদ করেছেন মেক্সিকোর কবি অক্টাভিও পাজ এবং ক্যারিবীয় কবি ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা। আধুনিক বাংলা ভাষায় বিনির্মাণ বা তর্জমা করেছেন মধ্যযুগের কবি বড়ু চ-ীদাসের ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। তিনি এই সময়ের চলমান প্রাতিষ্ঠানিক অভিধান অস্তিত্বকে অনেকটা বাতিল করে প্রণয়ন করেছেন আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধান।

তিনি লেখালেখিকে নিবিড় সাধনা আর জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রাজধানীতে টিকে থাকতে গিয়ে নিরন্তর লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে কবিকে। অসীম সাহা ‘পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২)’ লিখে কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। একে একে প্রকাশিত হয়, ‘কালো পালকের নিচে (১৯৮৬)’, ‘পুনরুদ্ধার (১৯৯২)’, ‘উদ্বাস্তু (১৯৯৪)’, ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১)’, ‘অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব (২০০৬)’, ‘মুহূর্তের কবিতা (২০০৬)’, ‘সৌর-রামায়ণ (২০১১)’, ‘কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১)’, ‘পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২)’ প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থ। ছড়া, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প ও অনুবাদেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন।

আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধানটি প্রণয়ন করার আগে নিয়ম করে প্রতিদিন এক ঘণ্টা ধরে টানা দশ বছর উপন্যাস পড়ার মতো যাবতীয় অভিধান পড়েছেন। তারপর আট বছর সময় ধরে তার নিজের অভিধানটি প্রণয়ন করেছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’ প্রভৃতি সম্মাননায় ভূষিত হন। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে যে ক’জন হাতেগোনা কবি ছন্দের শুদ্ধ প্রয়োগে সফলতা অর্জন করেছেন, অসীম সাহা তাদের অন্যতম। তার এই ছন্দ স্বাচ্ছন্দ্যই নিখুঁত ছড়া লেখা এবং গানের কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বাংলা একাডেমির বিভিন্ন অভিধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে অসীম সাহা বলেছিলেন—- ‘... বাংলা একাডেমি এ-পর্যন্ত অনেকগুলো অভিধান বের করেছেন। অনেক ভুল ও অসঙ্গতিতে ভরা এসব অভিধান সহযোগিতার বদলে অনেকক্ষেত্রেই বিভ্রম তৈরি করেছে।’ এ যে কত বড় সাহস ও গবেষণার কথা, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবে না।
ব্যাপক পড়াশোনা, জানাশোনা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি; পাবার লোভ আর হারাবার ভয় না থাকলেই একজন পরিণত বয়সের মানুষের মাঝে এই সাহস প্রকাশ পেতে পারে। তাঁর সহধর্মিনী কবি অঞ্জনা সাহাকেও দেখা যেত অনেকটা ছায়ার মতো তার পাশে থাকতে।
ধ্রুপদি সংগীত আর লোকসংগীতের সমন্বয়ে নতুন এক গীতধরার সৃষ্টি করেছেন কবি অসীম সাহা। তার একটি গানের দল ছিল যেটা দেশের বিভিন্ন সম্প্রচার মাধ্যমে এবং দেশের বাইরেও সংগীত পরিবেশন করেছে। তার স্ত্রী অঞ্জনা সাহা কবি ও সংগীতশিল্পী হিসেবে নন্দিত।

সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কবি। জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষে কাজ করেছেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হলে তিনি এর নেতৃস্থানীয় কবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শক্তিমান কবি অসীম সাহার কবিতাসহ লেখালেখির বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে তার বিচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বইয়ে।

১৯৭০ এর দশকে তার তারুণ্যে ‘প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা’ গ্রন্থ সাহিত্যে গণনীতি, কবিতায় পরিমিতি বোধ, স্বপ্নচারিতা, ছন্দ, মধুসূদনের লেখালেখি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, যাত্রা ও নাটক নিয়ে বিচিত্র সব প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন সংস্কৃতি রাজনীতি ও বিজ্ঞানের পরস্পর যোগসূত্র নিয়েও। তার সম্পাদনার হাত ছিল অত্যন্ত সুদক্ষ। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘চিরায়ত কিশোর কবিতা’। চিরায়ত এই গ্রন্থে আবদুল হাকিম থেকে শুরু করে রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর কবিতাসহ অর্ধশতক কবির কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারবে অনেক কিছু।

কবি অসীম সাহা ছিলেন ঢাকা শহরের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিম-লের অল্প কয়েকজন কবির অন্যতম কবি। অসীম সাহা কেবল বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতেও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। সভা সেমিনারে প্রাঞ্জল ভাষায় মনোমুগ্ধকর বক্তব্য নজর কাড়ত সাহিত্যপ্রেমী মানুষের। সেই জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল তার নানামুখী গুণ আর অনন্য লেখক সত্তা যা বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

×