
ছবি: সংগৃহীত
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, তার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার যোগ্য এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা আলোচনা শুধুমাত্র “আমাদের শর্তেই” হবে।
ভোট গণনার শেষ মুহূর্তে বিবিসিকে দেওয়া এক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে কার্নি বলেন, তিনি কেবল তখনই ওয়াশিংটন সফরে যাবেন, যখন “গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার” পরিবেশ সৃষ্টি হবে যা কানাডার সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি একাধিকবার কানাডাকে আমেরিকার “৫১তম রাজ্য” করার কথা বলেছেন, যা কানাডিয়ানদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
সোমবার অনুষ্ঠিত এক জরুরি নির্বাচনে তার লিবারেল পার্টির ঐতিহাসিক বিজয়ের পর কার্নি বলেন, এ ধরনের প্রস্তাব “কখনই, কোনোদিনও বাস্তবায়িত হবে না”।
তিনি আরও বলেন, “সত্যি বলতে, আমি মনে করি এটি অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রেও কখনই হবে না... হোক সেটা পানামা, গ্রিনল্যান্ড বা অন্য কোথাও।”
তবে কার্নি মনে করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্ভব হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করা যায়, তবে সেটি হবে কানাডার জন্য “উইন-উইন পরিস্থিতি”।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েনপূর্ণ সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র কানাডার জন্য একটি বড় বাজার—কানাডার প্রায় ৭৫ শতাংশ রপ্তানি যায় দক্ষিণে। অথচ কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির মাত্র ১৭ শতাংশ জোগান দেয়।
তেল সরবরাহেও কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি উৎস। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানাডার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর কথা, তার পেছনে মূলত জ্বালানির চাহিদা দায়ী।
সম্প্রতি ট্রাম্প কানাডাকে "৫১তম রাজ্য" হিসেবে উল্লেখ করা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে "গভর্নর" বলে আখ্যায়িত করায় দুই দেশের সম্পর্কে চাপ বাড়ে।
এছাড়াও ট্রাম্প যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, সেখানে কানাডা ছিল শুরুর দিকেই লক্ষ্যবস্তু। তিনি কানাডার বিভিন্ন পণ্যে আংশিকভাবে ২৫ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করেন এবং অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিল আমদানিতে পুরো ২৫ শতাংশ ট্যাক্স বসান। তবে উত্তর আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি (USMCA)-এর আওতায় থাকা পণ্যগুলো কিছুটা ছাড় পায়।
প্রতিবাদস্বরূপ কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর প্রায় ৬০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের (৪২ বিলিয়ন ডলার; ৩২ বিলিয়ন পাউন্ড) পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
কার্নি বলেন, “আমাদের শর্তে আলোচনা হবে, তাদের শর্তে নয়। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব গড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটা অতীতের মতো হবে না, হবে একেবারে আলাদা ধরনের।”
ট্যারিফ মোকাবিলায় অভিজ্ঞতাই কার্নির হাতিয়ার
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে কখনও রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও, ব্যাংকার হিসেবে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট মোকাবিলায় তার রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ২০০৮ সালে তিনি ছিলেন ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর এবং ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রধান, যিনি প্রথমবারের মতো একজন ব্রিটিশ নন।
কার্নি বলেন, “আমরাই যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টির বেশি রাজ্যের সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট। আমরা তাদের জ্বালানির প্রধান উৎস। আমরা তাদের কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ করি।”
“আমরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য। আমরা সম্মান আশা করি এবং আমি নিশ্চিত, শিগগিরই সেটা আবার ফিরে আসবে। তারপরই এসব আলোচনা সম্ভব হবে।”
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর অর্থনীতি গভীরভাবে সংযুক্ত। প্রতিদিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য—যেমন গাড়ির যন্ত্রাংশ—দেশগুলোর সীমান্ত অতিক্রম করে। ট্যারিফ আরোপ সেই সহযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ট্রাম্প দাবি করেন, ট্যারিফ আমেরিকানদের দেশীয় পণ্য কিনতে উৎসাহিত করবে এবং এতে করে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, তবুও ইউকে ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর ‘পারস্পরিক ট্যারিফ’ বসানোর কারণে বহু মিত্র দেশ নতুন বাণিজ্য চুক্তির খোঁজ করছে।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভসকে সমর্থন জানানো কার্নি বলেন, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে আটকে থাকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও বর্তমানে দেশ দুটির মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ বাণিজ্যই কার্যত শুল্কমুক্ত।
“আমরা চাইলে আমাদের মধ্যে আরও গভীর সমন্বয় গড়ে তুলতে পারি—চিন্তা করুন প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র, অনেক কিছুই করার আছে।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমার কার্নিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “আমি নিশ্চিত আমরা প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাব।”
কার্নি জানান, জুনে কানাডায় আয়োজিত আসন্ন G7 সম্মেলন হবে “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ”—বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে। এ সম্মেলনেই প্রমাণ হবে, বিশ্বের সাতটি সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশ এখনো একে অপরের প্রতি কতটা “সমমনা”।
উল্লেখ্য, সম্মেলনের সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগেই ট্রাম্পের আরোপিত উচ্চ ট্যারিফের ওপর ৯০ দিনের বিরতির সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে।
শহীদ