
ছবি: সংগৃহীত
গত শনিবার ভোররাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত গুজরাটজুড়ে অভিযানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করেছে রাজ্য পুলিশ। তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জনের বাংলাদেশি পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে বলে সোমবার (২৮ এপ্রিল) জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক বিকাশ সহায়।
পিটিআইকে তিনি জানান, আটককৃতদের মধ্যে নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে—৪৫০ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছিলেন। বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশের ধারণা, এদের মধ্যেও অনেকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হতে পারে।
আহমেদাবাদ ও সুরাটে শুরু হওয়া এই ধরপাকড় পরে পুরো গুজরাট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ খুঁজে বের করতে একাধিক এলাকায় একযোগে অভিযান চালায় পুলিশ।
এই অভিযানে আটক হওয়া সুলতান মল্লিকের স্ত্রী সাহিনা বিবি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাত তিনটার দিকে পুলিশ আসে। আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপর আমার স্বামী আর দুই ভাগ্নেকে নিয়ে যায়। বলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে, কিন্তু তিনদিনেও কোনো খোঁজ নেই।”
বিবিসি বাংলার হাতে থাকা পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালের জমির দলিল অনুযায়ী, সুলতান মল্লিক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি প্রায় ছয় বছর ধরে সুরাটে এমব্রয়ডারির কাজ করছেন। আটকের পর প্রথমে ফোন করে স্ত্রীকে সব নথি পাঠাতে বলেন তিনি, কিন্তু তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
এই ঘটনার জেরে সুলতানের পরিবার দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তার স্ত্রী বলেন, “মাত্র এক বছর হলো গুজরাটে এসেছি। এখন কোথায় গিয়ে স্বামীর খোঁজ করবো বুঝতে পারছি না।”
পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তায় হেল্পলাইন
পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন। গুজরাটে অভিযানের পর তারা একটি হেল্পলাইন চালু করেছে। সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক জানান, মাত্র দুদিনেই সেখানে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।
তিনি বলেন, “গুজরাটে বিষয়টি আলোচনায় এলেও অন্যান্য রাজ্য—যেমন উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্রেও একই ধরনের হয়রানি হচ্ছে। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠিও দিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ফল মেলেনি।”
সুলতান মল্লিকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা বাধ্যতামূলক। অথচ তিনদিন কেটে গেলেও তা হয়নি। এটা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
বরযাত্রীদেরও রেহাই নেই
আহমেদাবাদে পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ দপ্তরের সামনে দেখা হয় ফারজানা নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বরযাত্রীরা চান্দোলা এলাকায় এক আত্মীয়র বাসায় ছিলেন। সেখান থেকে পুলিশ তাদের ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করে।
ফারজানা বলেন, “আমার ভাই ও ভাতিজা মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে এসেছিল। আমাদের কাছে সব নথিপত্র ছিল, তবুও তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের হলদি অনুষ্ঠানও পিছিয়ে দিতে হয়।”
জেবুন্নেসা নামে আরেক নারী জানান, তাদের কাছে জন্মসনদ ও আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তার ছেলে ও ভগ্নীপতিকে ধরে নিয়ে যায়। অনেক বেকায়দায় পড়তে হয় তাদের।
অন্য রাজ্যেও একই ছবি
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের কাছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ১০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। তারা জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে।
একটি ঘটনায়, ১৮ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের কুশিনগরে মালদার ২৩ জন ফেরিওয়ালাকে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য মারধর করা হয়। পরে পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়, যদিও একদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরেক ঘটনায়, ২১ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে ৬০ জন শ্রমিক উড়িষ্যার কেওনঝড় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে স্থানীয়রা তাদেরও ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে মারধর করে। এতে তারা বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন।
আসিফ ফারুক বলেন, “২০১৪ সাল থেকেই এমন ঘটনা বাড়ছে। পহেলগামে হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নিয়মিতভাবে বাংলাভাষী মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।”
তার প্রশ্ন, “ভারতের নাগরিক হিসেবে কি আমরা দেশের যেকোনো প্রান্তে কাজ করার অধিকার পাবো না, শুধুমাত্র বাংলাভাষী আর মুসলিম হওয়ার কারণে?”
আসিফ