
ছবি: সংগৃহীত
২২ এপ্রিল, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামের মনোরম বেইসারান উপত্যকায় যখন সন্ত্রাসের ছায়া নামে এবং গুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তখন নিজেদের জীবন বাজি রেখে পর্যটকদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্থানীয়রা। এই সাহসী মানুষদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন পর্যটকদের ঘোড়ায় বহন করে। তাঁরাই ছিলেন প্রথম উদ্ধারকারী।
এই সাহসীদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাজ্জাদ আহমেদ ভাট, যাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায়, সন্ত্রাসী হামলার সময় তিনি এক আহত পর্যটককে পিঠে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বেশ কয়েক কিলোমিটার পাথুরে ঢাল বেয়ে একজন আহত শিশুকে পিঠে বহন করে নামিয়ে আনেন।
তাঁর পরিবারেও ওই দিন একজনের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু তাও তাঁকে থামাতে পারেনি। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “ওটা ছিল এক ভীতিকর দৃশ্য। নারী ও শিশুরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। চারপাশে এত মৃতদেহ দেখে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কাকে বাঁচাব।”
“আমি নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করিনি। পর্যটকরাও আমার পরিবারের অংশ। তাঁদের বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব। আমরা তাঁদের পানি সরবরাহ করি এবং ঘোড়ায় চাপিয়ে হাসপাতালে পাঠাই। ওই দিনটা আমরা ভুলব না। প্রতি বছর আমরা এই দিনটিকে 'কালো দিন' হিসেবে স্মরণ করব। যেন কেয়ামতের দৃশ্য ছিল সেটা,” যোগ করেন সাজ্জাদ ভাট। তবে শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই বিপদের মুহূর্তে পাশে ছিলেন।
ঘোড়াচালক সমিতির সভাপতি রইস আহমেদ, যিনি ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাঁপছিলেন, বলেন “আমরা যখন বেইসারানে পৌঁছালাম, একটি মৃতদেহ দেখতে পাই এবং মনে হলো আজই আমার শেষ দিন। এক নারী এসে অনুরোধ করেন, ‘আমার স্বামীকে বাঁচান।’ আমরা তাঁকে গেট পর্যন্ত নিয়ে যাই এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। পুরো উপত্যকা জুড়ে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল।”
এদের মধ্যে ছিলেন ২৮ বছর বয়সী ঘোড়াচালক সৈয়দ আদিল হুসেইন শাহ, যিনি সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁকে স্মরণ করে রইস আহমেদ বলেন, “উপত্যকাটি বেড়া দিয়ে ঘেরা। শুধুমাত্র পর্যটকরাই ভিতরে যেতে পারেন। যদি বেড়াটি না থাকত, অনেক আদিলই ঝাঁপিয়ে পড়তেন পর্যটকদের রক্ষায়।”
ঘোড়াচালক আব্দুল মজিদ বলেন, “বিকেল ৩টায় আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সমিতির সভাপতি একটি বার্তা পাঠান—বেইসারানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সবাইকে দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে হবে।”
“একজন সাজ্জাদের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই দিন শত শত সাজ্জাদ নিজের জীবন তুচ্ছ করে অন্যদের বাঁচিয়েছেন। সন্ত্রাসীরা ছিল নরপিশাচ। আমরা এই দিনটা কখনও ভুলব না,” বলেন মজিদ। একই পেশার নেসার আহমেদ ভাট বলেন, “আমি এবং আরও অনেকে আহতদের কাঁধে তুলে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি।”
একজন কাঁপা কণ্ঠে বলেন, “আমরা এখনও আতঙ্কিত। ঘটনার আগে এত খুশি ছিলাম! আমার বাড়িতে বহু পর্যটক এসেছিলেন, আমরা খুব আপন হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সন্ত্রাসীরা আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। আমি এখনও পর্যটকদের বলব, কাশ্মীরে আসুন, আমাদের আতিথেয়তা দেখুন। আমরা আপনাদের পাশে আছি।”
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোদের মধ্যে ছিলেন একজন পরিবেশকর্মীও। তিনি বলেন, “আল্লাহ আমাদের রিজিক দেন। এই বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আমি সারা দেশ ঘুরেছি, ভারতের বৈচিত্র্য দেখেছি। পহেলগামেও সেই বৈচিত্র্য রয়েছে। এই ভূমি আল্লাহ এবং শিব দুজনেরই।”
পহেলগামের রেস্তোরাঁ মালিক নরেন্দ্র সিং বলেন, “২২ এপ্রিলের সেই ঘটনা এখনও আমার মানসিক শান্তি নষ্ট করে রেখেছে। আমরা ভগবানভীরু মানুষ, পর্যটকদের দেবতার মতো সেবা করি। ধর্ম আলাদা হলেও আমরা ঐক্যবদ্ধ।”
রইস আহমেদ ওই হামলাকে ‘মানবতার হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন এবং পর্যটকদের কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল না করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আপনার যদি বুকিং থাকে, দয়া করে পহেলগামে আসুন।”
সাজ্জাদ ভাটও একই আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমার ভারতীয় ভাই ও সব পর্যটকের উদ্দেশ্যে বলছি—ভয় পাওয়ার দরকার নেই। কাশ্মীরে আসুন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।” এই মানুষগুলোর মুখে হয়তো ভাষা নেই, কিন্তু তাঁদের হৃদয়ের কষ্টে ফুটে উঠেছে একটাই বার্তা— ‘আমাদের নামে নয়, তোমরা খুনি।’
শহীদ