
ছবি : সংগৃহীত
ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ত শহর মুম্বাই। একদিকে এখানে রয়েছে বলিউড তারকাদের রাজকীয় বাসভবন, বিলাসবহুল জীবনযাপন, ঝলমলে শপিং মল, অন্যদিকে শহরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ধারাভী, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বস্তি। মাত্র ২.১ বর্গ কিলোমিটারের এই এলাকায় বসবাস করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ, অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ।
তবে ধারাভী শুধু একটি বস্তি নয়, এটি একটি পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে রয়েছে হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসা- কাপড়, চামড়া, মৃৎশিল্প থেকে শুরু করে রিসাইক্লিং পর্যন্ত। ধারাভীর বার্ষিক ব্যবসায়িক আয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমানে ধারাভী নিয়ে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আদানি গ্রুপ। এই বিশাল এলাকার পুনর্গঠনের দায়িত্ব এখন তাদের হাতে। ২০০৪ সালে প্রথম এই পুনর্গঠন প্রকল্পের পরিকল্পনা করে মহারাষ্ট্র সরকার, তবে বাসিন্দাদের আপত্তি ও রাজনৈতিক জটিলতায় প্রকল্পটি স্থগিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে দুবাই-ভিত্তিক সেকলিংক টেকনোলজিস কর্পোরেশন টেন্ডার জিতলেও তা বাতিল হয়। অবশেষে ২০২২ সালে নতুন শর্তে আয়োজিত টেন্ডারে জয়লাভ করে আদানি গ্রুপ।
২.৪ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে আধুনিক ফ্ল্যাট, স্কুল, হাসপাতাল ও শপিং মলের। তবে প্রশ্ন উঠেছে- আদানির প্রকৃত লাভ কোথায়?
ধারাভীর অবস্থানই আদানির প্রকল্পের মূল চালিকাশক্তি। এর পাশেই রয়েছে বাঁধাকুল্লা কমপ্লেক্স- মুম্বাইয়ের সবচেয়ে দামি অফিস এলাকা এবং বলিউড তারকাদের আবাসস্থল। এই এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করলে প্রতিটি ইউনিটের মূল্য দাঁড়াবে কোটি কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আদানির প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য পুনর্বাসন নয়, বরং জমির প্রকৃত মূল্য কাজে লাগিয়ে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়া।
ভারত সরকার বলছে, এটি ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নগর উন্নয়ন প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবে এখানকার বাসিন্দারা কতটা উপকৃত হবেন, তা নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। নিয়ম অনুযায়ী, শুধু তারাই ফ্ল্যাট পাবেন যারা ২০০০ সালের আগে ধারাভীতে বাস করছেন। কিন্তু বহু পরিবার রয়েছে যারা পরে এখানে এসেছে—তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে?
এছাড়া প্রতিটি পরিবারের জন্য নির্ধারিত ফ্ল্যাটের আয়তন মাত্র ৩৫০ স্কয়ার ফুট, যা অনেকের বর্তমান বাসস্থানের তুলনায় ছোট। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জীবিকা। ধারাভীর প্রায় ৫০০০ ছোট শিল্প ও ১৫,০০০ ক্ষুদ্র কারখানাই এখানকার মানুষের জীবনের অবলম্বন। আদানির প্রকল্পে এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা একেবারেই উপেক্ষিত।
ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম এই প্রকল্পকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে তুলে ধরছে। ধারাভীর মানুষদের অপরাধপ্রবণ, নোংরা পরিবেশে বাস করা লোক হিসেবে চিত্রায়িত করে বলা হচ্ছে, আদানি গ্রুপই তাদের একমাত্র মুক্তির পথ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে হাজার হাজার বাসিন্দা প্রতিবাদ করলেও তা মিডিয়ায় তেমন জায়গা পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারাভীর মত স্পর্শকাতর এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সেটি হওয়া উচিত স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে, তাদের জীবনের বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে। না হলে শুধু বিলাসবহুল ভবন উঠে দাঁড়ালেও সেখানে থাকবে না কোনো হাসিমুখ, থাকবে শুধু ক্ষোভ আর হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প।
আঁখি