
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা
কাশ্মীরে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। দেশ দুটির পাল্টাপাল্টি অবস্থান নতুন করে যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি করেছে। এরইমধ্যে সীমান্তে নিয়মিত গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো উভয় দেশকে শান্ত থাকার এবং সংকট সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ভারত এখন সংঘাত এড়াতে নয় বরং পাকিস্তানে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দাবি প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের।
২২ এপ্রিলের পর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের অন্তত এক ডজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তবে এ প্রচেষ্টা মূলত পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর জন্য নয়, বরং সামরিক পদক্ষেপে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়েছে। সম্প্রতি এক ভাষণে মোদি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে এবং দোষীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, ভারত সরাসরি সামরিক পদক্ষেপের দিকে এগোতে পারে। কাশ্মীর পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ।
ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে এবং হামলায় জড়িতদের সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তির আওতায় পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে এবং পাকিস্তানি কূটনীতিক ও নাগরিকদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাকিস্তানও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। পাক রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসি সাফ বলেন, ‘পাকিস্তানের ১৩০টির বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র এমনি এমনি সাজিয়ে’ রাখা হয়নি। এগুলো শুধুই ভারতের জন্য রাখা হয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ান, এনডিটিভি ও আল জাজিরা অনলাইনের।
হানিফ আব্বাসি বলেন, এসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই তোমাদের (ভারতের) দিকে তাক করা আছে। আব্বাসির এমন মন্তব্য দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে দুটি কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে। উভয় দেশই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। তবে বর্তমানে দুই দেশ এর ভিন্ন ভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভারত ও পাকিস্তান আরও কয়েকবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এর জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন হিমালয় অঞ্চলকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। হামলার পাঁচদিন পরেও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম প্রকাশ করেনি বা পাকিস্তানের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ভারতের কর্মকর্তারা কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের অতীতে সন্ত্রাসীদের মদতদানের কথা উল্লেখ করলেও তা আন্তর্জাতিক মহলের সামনে প্রকাশ করা হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হয়ত ভারত আরও তথ্য সংগ্রহ করছে অথবা আন্তর্জাতিক অস্থিরতার সুযোগে তারা ব্যাখ্যা না দিয়েই পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান এবং সৌদি আরব উভয়পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিগুলোর মনোযোগ বর্তমানে অন্যান্য সংকটের দিকে হওয়ায়, ভারত কার্যত কোনো আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়াই এগোচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টায় সমর্থন প্রকাশ করেছে। তবে সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে যখন কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বড়সড় হামলা হয়েছিল তখনো ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমে ভারতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল এবং পরে যখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল, তখনই সংযমের আহ্বান জানিয়েছিল। ২০১৯ সালের কাশ্মীর সংঘর্ষের প্রসঙ্গ টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবারও ভারত হামলার জবাবে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল, যার পরিণতিতে পাকিস্তান ভারতের একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিল এবং পাইলটকে বন্দি করেছিল। পাক-ভারত উত্তেজনার মধ্যে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে নয়াদিল্লি। রবিবার ভারতের নৌবাহিনী এ পরীক্ষা চালায়।
সামাজিক মাধ্যম এক্সে নৌবাহিনীর দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সফলভাবে জাহাজ বিধ্বংসী বিভিন্ন ধরনের মহড়া চালানো হয়েছে। তারা বলছে, এর মধ্য দিয়ে প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম ও ক্রুদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর প্রস্তুতি যাচাই করা হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উদ্ভূত পরিস্থিতির দিকে নিবিড়ভাবে নজর রাখছে চীন। রবিবার পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে এক ফোনালাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এ কথা বলেছেন।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপে তারা ভারত প্রসঙ্গে কথা বলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার চীন, যুক্তরাজ্য ও ইরানের নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাদা করে কথা বলেছেন। এ সময় তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির ‘ভিত্তিহীন প্রচার ও একতরফা পদক্ষেপগুলোর’ প্রতি এসব নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে ভারতের নেওয়া একতরফা পদক্ষেপের বিষয়েও কথা বলেন তারা। ইসহাক দার যুক্তরাজ্য ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন এবং ইসলামাবাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অবিচল সংকল্পের পাশাপাশি এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। পাকিস্তানের ১৬ ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তালিকায় ডন নিউজ, সামা টিভি, এআরওয়াই নিউজ ও জিও নিউজের মতো পাকিস্তানের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো রয়েছে।