ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

সিন্ধুর এক ফোঁটা পানিও পাবে না পাকিস্তান ॥ ভারত

যুদ্ধের শঙ্কায় বাঙ্কার তৈরি করছে ভারতীয়রা

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

যুদ্ধের শঙ্কায় বাঙ্কার তৈরি করছে ভারতীয়রা

কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে যুদ্ধের খুব কাছাকাছি

কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান। শুক্রবারও রাতভর সীমান্তে উভয় দেশের সৈন্যরা দফায় দফায় গুলিবিনিময় করে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বড় হামলার শঙ্কায় ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দারা বাঙ্কার তৈরি করছে। শনিবার ভারতের একাধিক গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি প্রকাশিত হয়। খবর আল-জাজিরা, এনডিটিভি ও ডন অনলাইনের।  
এতে বলা হয়, কাশ্মীরের পুঞ্চ বিভাগে বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সেখানকার সালোত্রি গ্রাম, যা ভারতের শেষ অংশ, সেখানে উত্তেজনা বেশি। সেখানে ইতোমধ্যে গত দুইদিন গোলাগুলি হয়েছে। এতে সালোত্রি গ্রামের মানুষ সম্ভাব্য বড় হামলা থেকে বাঁচতে তাদের কমিউনিটি বাঙ্কারগুলো পরিষ্কার ও প্রস্তুত করছেন। কেউ কেউ আবার নতুন করে বাঙ্কার তৈরি করছে। এই গ্রামবাসী লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) খুব কাছাকাছি থাকায় তাদের মধ্যে শঙ্কা বেশি।

এসব শঙ্কার মধ্যেই নিজেদের প্রস্তুতি সেরে রাখছেন তারা। এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, পাক সেনারা ছোট অস্ত্র দিয়ে ভারতীয় সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীও কঠোর জবাব দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। 
সালোত্রির বাসিন্দারা জানান, ভারত সরকার তাদের এসব বাঙ্কার বানিয়ে দিয়েছে। যেগুলো অনেক শক্তপোক্ত। একইসঙ্গে বুলেটপ্রুফ। এছাড়া এগুলো গোলাবর্ষণের সময়ও নিরাপত্তা দেবে। বাঙ্কারগুলো তৈরি করা হয়েছে মাটির ১০ ফুট নিচে। অপর এক গ্রামবাসী বলেন, আমরা সীমান্ত এলাকায় বাস করি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেসামরিকদের জন্য যেসব বাঙ্কার দিয়েছেন। এগুলো খুবই শক্তিশালী, বুলেটপ্রুফ এবং মাটির ১০ ফুট নিচে। এগুলোর ভেতর কোনো ঝুঁকি নেই।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। এখানে আমরা খুবই নিরাপদ বোধ করি। তিনি বলেন, কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে সশস্ত্র হামলাকারীরা যা করেছে তা কাপুরুষচিত। এ ঘটনার জবাব দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। যখন ভারতীয় সেনারা জবাব দেবে তখন আমাদের নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। এজন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা আমাদের বাঙ্কার নিয়ে প্রস্তুত।
সিন্ধু নদের পানি প্রত্যাহার নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। ভারতকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে তার তার দল যেমন একটি বিতর্কিত খাল প্রকল্প হতে দেয়নি, ঠিক একইভাবে পাকিস্তানের জনগণ সিন্ধু নদের ওপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এর সমুচিত জবাব দেবে। শুক্রবার এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘সিন্ধু আমাদের ও এটি আমাদেরই থাকবে। এর ওপর দিয়ে হয় আমাদের পানি, নয় তাদের রক্ত বইবে।
বিলাওয়ালের এই কথার পরপরই ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল বলেন, ‘সিন্ধু উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর এক ফোঁটা পানিও যাতে পাকিস্তানে না যায়, আমরা তা নিশ্চিত করব। গুজরাটের নবসারি আসন থেকে চারবার লোকসভায় নির্বাচিত চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল গুজরাট রাজ্য বিজেপির সভাপতি। 
শুক্রবার ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, ‘সিন্ধুর পানি চুক্তি নিয়ে মোদি সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আইনসঙ্গত ও জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। আমরা নিশ্চিত করব, এক ফোঁটা পানিও যাতে পাকিস্তানে প্রবাহিত না হয়।
কাশ্মীর ও লাদাখ সীমান্তে গোলাগুলি প্রসঙ্গে ভারতের সেনা কর্মকর্তারা বলেন, শুক্রবার রাতে সীমান্তের ওপারের একাধিক সেনা চৌকি থেকে গুলি ছোড়া হয়। তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে ভারতীয় সেনারা।
ভারতের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, ২০২৫ সালের ২৫-২৬ এপ্রিল রাতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা জুড়ে একাধিক পাকিস্তান সেনা চৌকি থেকে বিনা উস্কানিতে ছোট আকারে গুলি চালানো হয়। ভারতীয় সেনারা ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। এতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।’ কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৬ পর্যটক নিহত হন। এরপর থেকেই উত্তেজনার শুরু। ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি সংগঠন এর দায় স্বীকার করেছে। সংগঠনটি পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। 
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে ইরান ও সৌদি আরব।
শনিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রস্তাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ দুটির সঙ্গে তেহরানের কয়েক শতাব্দী পুরনো ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের’ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি ফার্সি কবিতারও কয়েকটি চরণও উদ্ধৃত করেছেন। 
এক্সে দেওয়া পোস্টে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকেই ‘ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী’ বলে সম্বোধন করেছেন। ভারত ও পাকিস্তান ইরানের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক শতাব্দীপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার বন্ধনে গাঁথা। অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো, তাদের প্রতিও আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকে। এই কঠিন সময়ে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে তেহরান মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত বলে তিনি জানান। 
এই মন্তব্যের সঙ্গেই তিনি জুড়ে দিয়েছেন ‘বনি আদম’ কবিতার কয়েকটি চরণ, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘মানুষ এক অখ- সত্তার অংশ, সৃষ্টিতে তাদের মূল এক ও অভিন্ন। যদি একজন ব্যথিত হয়, তবে অন্যরাও স্বস্তিতে থাকতে পারে না। ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত এই ফার্সি কবিতার লেখক ইরানি কবি সাদি শিরাজি।
সৌদি আরবও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতাকারী হতে প্রস্তাব দিয়েছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এরই মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোনও করেছেন। 
এক বিবৃতিতে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর সম্পর্কের সমাধান তারা নিজেরাই বের করবে। শুক্রবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, পাক-ভারত সীমান্তে ১,৫০০ বছর ধরেই উত্তেজনা রয়েছে। কাজেই তারা নিজেরাই চলমান উত্তেজনা মিটিয়ে নেবে। 
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীর অঞ্চলটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত রয়েছে। উভয় দেশই পুরো অঞ্চলের ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করে, তবে আলাদাভাবে শাসন করে আসছে। ভারতশাসিত কাশ্মীরে ১৯৮৯ সাল থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে। মঙ্গলবার এই জঙ্গি হামলার পর থেকেই পাকিস্তানের যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ নয়াদিল্লির। তবে ইসলামাবাদ বলছে, তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনকেই মদদ দেয় না।

তবে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর প্রতি তাদের নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন আছে। এই জঙ্গি হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেয়। পাকিস্তানও একই কাজ করে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এ সময় তারা রাষ্ট্রপতির কাছে দুটি লাল ফাইল জমা দেন। এই ফাইল ঘিরেই শুরু হয়েছে জল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, ফাইল দুটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে সম্ভবত যুদ্ধের অনুমতি চেয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। একটি ফাইলে যুদ্ধের অনুমতি চাওয়া হয়।

অপরটিতে অতি বিরূপ পরিস্থিতিতে ভারতের সর্বশেষ শক্তি ব্যবহারের সবুজ সংকেতের বিষয়টি উল্লেখ আছে। এই খবরের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, ভারত যদি আক্রমণ করে, অবশ্যই সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে। ভারতকে অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, আফগানিস্তানের টিটিপিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী রয়েছে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের ধরন ভারতের মতোই। কুলভূষণ যাদব সন্ত্রাসবাদে ভারতের জড়িত থাকার জীবন্ত প্রমাণ।

পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, বেলুচ লিবারেশন আর্মি এবং তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তানের নেতারা ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়, আমরা সম্পূর্ণভাবে ভারতের যে কোনো অভিযানের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। খাজা আসিফ বলেন, ভারত যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পুলওয়ামায় অতীতে যেভাবে কঠোর জবাব দেওয়া হয়েছিল, এবারও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে। 
চলমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও ভারতকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বলেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, একমাত্র সংযম ও ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে উভয় দেশ বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

×