
ছবি : সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে প্রস্তাবিত স্থলপথ সংযোগ প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত করেছে শ্রীলঙ্কা। পক প্রণালী পেরিয়ে সেতু বা করিডোর নির্মাণের যে পরিকল্পনা ছিল, তা নিয়ে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কলম্বো সফরে আলোচনা হলেও শ্রীলঙ্কা সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা বর্তমানে এই প্রকল্পে এগোতে প্রস্তুত নয়।
এই সংযোগের ভাবনা প্রথম আলোচনায় আসে ২০০২-২০০৪ সালের মধ্যে, তখনকার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের আমলে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০২৩ সালে দিল্লি সফরের সময়ও তিনি বিষয়টি যৌথ বিবৃতিতে তোলেন। কিন্তু চলতি বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা ডিসানায়েকের দিল্লি সফরে সেটি আলোচ্যসূচি থেকে বাদ পড়ে যায়।
মোদি ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক বৈঠকে পক প্রণালীর ওপরে সেতু নির্মাণ ছাড়াও বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগ ও ত্রিনকমালেতে ১২০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। মোদি হেলিকপ্টারে করে ‘রাম সেতু’ নামক ঐতিহাসিক স্থান পর্যবেক্ষণও করেন, যা হিন্দু ধর্মীয় কাহিনিতে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সংযোগ হিসেবে বিবেচিত। তবে শ্রীলঙ্কার শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা এই স্থলপথ প্রকল্পের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। কলম্বোর কর্মকর্তারা জানান, এটি বাণিজ্য ও পর্যটনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু পরিবেশগত ঝুঁকি, অর্থনৈতিক দায় ও জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে এখনই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রকল্পটি মান্নার উপসাগরের সংরক্ষিত জীববৈচিত্র্য অঞ্চল, প্রবাল প্রাচীর, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল জুড়ে পড়বে-যা পরিবেশবাদী মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা, যার ফলে এমন বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের আগে গভীরভাবে লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এক মন্ত্রিপরিষদ কর্মকর্তা জানান, বিদেশি অর্থায়ন, জটিল কূটনৈতিক সমঝোতা এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করে এই ধরনের প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এই স্থলপথ পরিকল্পনা ভারতের বৃহত্তর আঞ্চলিক সংযোগ কৌশলের অংশ, বিশেষত বিমসটেক কাঠামোর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযুক্তি জোরদার করাকে কেন্দ্র করে। ভারত মনে করে, এই সেতু পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিমান ও নৌপথের উপর চাপ কমাতে পারে এবং নেট-জিরো কার্বনের লক্ষ্যে সহায়ক হতে পারে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি।
শ্রীলঙ্কার এই অনীহা কেবল পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক কারণে নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার বন্দর ও সামুদ্রিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পটভূমিতে, দেশটি এখন আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে সংযোগমূলক প্রকল্প বিবেচনা করছে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখাও শ্রীলঙ্কার প্রধান অগ্রাধিকার।
তবে ভারতের পক্ষ থেকে এখনো আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই মডেলে ফেরি সার্ভিস, সবুজ শিপিং করিডোর বা কম-প্রভাবশালী বিমান সংযোগের মাধ্যমে সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই ঘটনাপ্রবাহ আঞ্চলিক উন্নয়নের একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—সংযোগ শুধু অবকাঠামো দিয়ে নয়, বরং আস্থা, পরিবেশ সচেতনতা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতার ভিত্তিতে গড়ে উঠে। আপাতত পক প্রণালীর ওপরে স্থলসেতুর পরিকল্পনা স্থগিত হলেও ভবিষ্যতে সম্ভাবনার দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।
আঁখি