ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

মরতেই যদি হয়, আমি বীরের মতো মরব: গাজার সাংবাদিক

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ১৯ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৯:০৪, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

মরতেই যদি হয়, আমি বীরের মতো মরব: গাজার সাংবাদিক

ছবিঃ সংগৃহীত

ফাতিমা হাসুনা, মাত্র ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। গাজার এক কন্যা, যিনি ক্যামেরা হাতে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সত্যিটা তুলে ধরছিলেন—নিজের জীবন বাজি রেখে। জানতেন মৃত্যু খুব কাছে, জানতেন এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে। তবু থামেননি। কারণ তিনি শুধু ছবি তুলছিলেন না—তিনি ইতিহাস লিখছিলেন, যন্ত্রণার মুখে সাহসের ভাষা বলছিলেন।

তার চোখে ছিল আগুন, কথায় ছিল দৃঢ়তা। তিনি বলেছিলেন, “যদি মৃত্যু আসে, আমি চাই তা যেন বীরের মতো হয়। আমি হারাতে চাই না, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাই না।” এবং ঠিক সেটাই হলো।

বিয়ের কয়েকদিন আগে, একটি ইসরায়েলি বিমান হামলা সরাসরি আঘাত হানে ফাতিমার বাড়িতে। এক মুহূর্তেই সব থেমে গেল। প্রাণ হারালেন তিনি, আর সঙ্গে ছিলেন তার পরিবারের আরও ১০ জন—একজন গর্ভবতী বোনও।

ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, তারা হামাসের এক সদস্যকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু যারা ফাতিমাকে চিনতেন, যারা তার কাজ দেখেছেন, তারা জানেন—এই তরুণী কোনো যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সাক্ষ্যদাতা। যুদ্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে যিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকে, কাঁদে, আশা করে।

তাঁর গল্প থেমে যাওয়ার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল দূর দেশে—ইরানিয়ান পরিচালক সেপিদেহ ফারসির ক্যামেরায়। Put Your Soul on Your Hand and Walk নামের ডকুমেন্টারিতে ছিল ফাতিমার জীবন, প্রতিদিনের যুদ্ধ, তার হাসি আর কান্না। সেই চলচ্চিত্র দেখানো হবে কানের ‘অ্যাসিড’ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।

সেপিদেহ বলেন, “ গাজায় সে ছিল আমার চোখের মত ছিল । আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম, শুধু তথ্য জানার জন্য না—ওর সাহস থেকে নিজেও বেঁচে থাকার শক্তি পেতাম।”

গাজায় সাংবাদিকদের জন্য এটা সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। ২০২৩ সাল থেকে অন্তত ১৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ফাতিমা এখন তাদের মধ্যে একজন, কিন্তু কেবল একজন নাম নয়, কেবল একটি সংখ্যা নয়—তিনি হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের মুখ।

তার সহকর্মীরা বলছেন, “চারপাশে যখন বোমা পড়তো, তখন সে ছবি তুলতো। সে মানুষের কান্না ধরে রাখতো ক্যামেরায়, যেন কেউ ভুলে না যায়।”

মৃত্যুর কিছুদিন আগে, ফাতিমা গাজার একজন কবিকে বলেছিলেন, “আমার জন্য একটি কবিতা লিখো, যদি আমি না থাকি।”

কবিতায় লেখা ছিল—

“আজকের সূর্য কারো ক্ষতি করবে না,
গাছেরা নিজেরা সাজবে এক মেহমানকে বরণ করতে,
রোদ থাকবে এমন যে মায়েরা সহজে কাপড় শুকাতে পারবে,
আর শিশুরা সারাদিন খেলা করতে পারবে।
আজকের সূর্য কারো প্রতি নিষ্ঠুর হবে না।”

এখন ফাতিমা আর নেই। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সে হারিয়ে যায়নি ভিড়ের মধ্যে। সে বেঁচে আছে, প্রতিটি ছবিতে, প্রতিটি স্মরণে, প্রতিটি চোখের জল আর প্রতিটি বুকে আগুন হয়ে।

সে গেছে, কিন্তু নীরবে না—সে গেছে এক গর্জনে।
বীরের মতো।

 

মারিয়া

×