
ছবি: সংগৃহীত
সময়ের কঠিন বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র যেন দেশটির পিছু লেগেছে ছায়ার মতো। আলটিমেটাম, নিষেধাজ্ঞা আর সামরিক হুমকি— সব মিলিয়ে চাপে চাপে কোণঠাসা তেহরান। তবে কথায় আছে, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। সেই কথাকেই সত্যি করে ইরানের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা বদলালেও ইরানবিরোধী অবস্থানে তেমন কোনো বদল আসেনি। বরং ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগে আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ওয়াশিংটন। তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে একের পর এক হুমকি, অবরোধ আর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছে মার্কিন প্রশাসন।
ঠিক এই সময়েই রাশিয়া এবং চীন জানিয়েছে, তারা ইরানের পাশে আছে। পরমাণু ইস্যুতে ইরানের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে রাশিয়া বলেছে, তারা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিকভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এক বিবৃতিতে জানান, রাশিয়া নিয়মিত ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
চীনও একইভাবে বলেছে, পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সম্মান দেখাতে হবে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, এই সংকটের সূচনা হয়েছিল সেই দেশ থেকেই, যারা একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল—অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র। চীন চায়, সব পক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগিয়ে যাক এবং বলপ্রয়োগের পথ পরিহার করুক।
অন্যদিকে, ইরান নিজের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)-এর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের কাছে রয়েছে হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ২০২৩ সালে এক মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা কংগ্রেসকে জানান, ইরানের কাছে ৩ হাজারের বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি জানিয়েছেন, ইরান এমন সব উপাদান সংগ্রহ করেছে যা দিয়ে ছয় থেকে সাতটি পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। যদিও তিনি নিশ্চিত করেছেন, ইরানের কাছে এখনো কোনো পরমাণু অস্ত্র নেই।
তবে তেহরানের দাবি, তাদের পরমাণু কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ এবং দেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এই বক্তব্য মানতে নারাজ। ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেন, যদি ইরান চুক্তিতে না আসে, তাহলে সামরিক ব্যবস্থা নিতে তারা প্রস্তুত।
এই টানাপোড়েনের মাঝেই আলোচনার পথে এক চিলতে আশা জেগেছে। ১২ এপ্রিল ওমানের রাজধানী মাস্কটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের প্রতিনিধিরা পরোক্ষ আলোচনায় বসে। ওমানের মধ্যস্থতায় হওয়া আলোচনায় দুই দেশের প্রতিনিধি দল আলাদা কক্ষে বসে তথ্য আদান-প্রদান করে। আলোচনায় ইরানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ।
ইরান জানিয়েছে, তারা চায় শান্তিপূর্ণ সমাধান। আব্বাস আরাকচি বলেন, আলোচনার পরিবেশ ছিল গঠনমূলক এবং ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে উভয় পক্ষের মধ্যেই। যদিও ইরান সরাসরি ট্রাম্পকে বিশ্বাস না করার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেন, আলোচনা “মোটামুটি ভালো” চলছে। তবে তিনি আবারও হুশিয়ারি দিয়েছেন, যদি চুক্তি না হয়, তাহলে ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারিন লেভিড বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকুক।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বহুদিনের জটিলতা সত্ত্বেও ওমানের মধ্যস্থতায় গৃহীত এই আলোচনার ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে সমঝোতার এক ক্ষীণ আশার রেখা দেখাচ্ছে। এখন নজর ১৯ এপ্রিলের দিকে—সেদিনের বৈঠকেই হয়তো নির্ধারিত হবে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির ভবিষ্যৎ, কিংবা নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে গোটা অঞ্চল। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, এই দুঃসময়ে ইরানের পাশে যে দেশদুটি নিঃশর্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তারা হল রাশিয়া ও চীন।
ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/VvgPrnsDWo0?si=CiovoeJsvM3BNo5d
এম.কে.