
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকার আকাশ আজ আর নীল নয়— সেখানে শুধুই ধোঁয়ার কুন্ডলী, বিস্ফোরণের লাল ঝলক, বারুদের গন্ধ আর মানুষের আর্তনাদ। স্কুল, হাসপাতাল, ঘরবাড়ি সবই আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শিশুর কান্না থামার আগেই নেমে আসে নতুন হামলা। এমন নির্মম আগ্রাসন চালানোর যে সাহস, শক্তি ও সুযোগ ইসরায়েলের রয়েছে, সেটি কোথা থেকে আসছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বিপুল আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা। মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো এসব দেশই একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে দিচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক সহায়তার ৬৯ শতাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। শুধু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়েছে প্রায় ১৭.৯ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে আয়রন ডোম ও ডেভিড স্লিং-এর উন্নত সংস্করণ, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, স্টেলথ ও এআই প্রযুক্তি, হেলফায়ার ও জেডিএএম গাইডেড মিসাইলসহ আরও অনেক মারাত্মক অস্ত্র।
২০১৬ সালের একটি সামরিক চুক্তির আওতায় ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েল পাবে আরও ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা, যার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ইতোমধ্যে দেশটি পেয়েছে ৪২টি এফ-৩৫। ১৯৫১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে ৩১৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
তবে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে আরও অনেক পশ্চিমা দেশ। জার্মানি ২০২৩ সালে ইসরায়েলকে ৩৫১ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। জার্মানির তৈরি ছয়টি ডলফিন-শ্রেণির সাবমেরিন ইসরায়েলি নৌবাহিনীর মেরুদণ্ড, যার তিনটিতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনের সক্ষমতাও রয়েছে।
ইতালি তাদের অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ তিন গুণ বাড়িয়েছে। তাদের তৈরি এম-৩৪৬ প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহৃত হচ্ছে ইসরায়েলি পাইলটদের উন্নত প্রশিক্ষণে। এসএআর-৫ করভেট যুদ্ধজাহাজের মাধ্যমে তারা সমুদ্রপথে নজরদারি ও অবরোধ চালাচ্ছে।
যুক্তরাজ্য সরাসরি অস্ত্র না দিলেও ২০২৩ সালে ৫২.৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দিয়েছে ইসরায়েলকে, যার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মুনাফা লুটছে। ফ্রান্স কিছুটা সতর্ক হলেও তাদের থ্যালাস গ্রুপের মাধ্যমে ইসরায়েল পাচ্ছে আধুনিক রাডার ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।
এশিয়ার দেশ ভারত, যারা একসময় ফিলিস্তিনের পাশে থাকার কথা বলত, আজ ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তারা যৌথভাবে ব্যারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র ও হেরন ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া— এই দেশগুলিও নিয়মিতভাবে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে চলেছে।
গাজার রক্তাক্ত ভূমিতে ফোঁটা প্রতিটি রক্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এসব দেশের অর্থ ও প্রযুক্তির ছাপ। ফলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলছে— নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য যে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে, তা বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?
পশ্চিমা বিশ্বের এই নীরব মদদ ও দ্বিমুখী নীতি বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। মুসলিম দেশগুলো সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, রাজপথে বিক্ষোভে মুখর। স্পেন ২০০৯ সাল থেকেই ইসরায়েলের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়ামও একই পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবুও বড় শক্তিগুলো আজও নিরব দর্শক। তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আর অস্ত্রবাজার গরম রাখার কৌশলে ফিলিস্তিনের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে। তাই গাজার প্রতিটি রক্তফোঁটা শুধু ইসরায়েলের নয়, বরং এই শক্তিধর মিত্র রাষ্ট্রগুলোকেও দাঁড় করাচ্ছে ইতিহাসের কাঠগড়ায়।
ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/KHxcc8EK5P0?si=yTzD-YPwbcibaytl
এম.কে.