
ছবি: প্রতীকী
ভারতের উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের কোলে প্রত্যন্ত এক শহর নন্দনগর। ছোট্ট সে শহরে এখন অবশিষ্ট আছে একটিমাত্র মুসলিম পরিবার, সে পরিবারের কর্তা ৪৯ বছরের আহমেদ হাসান। নন্দনগর এক সময় ১৫টি মুসলিম পরিবার বাস করত, সেখানে এখন টিকে থাকার লড়াই করছে শেষ মুসলিম পরিবারটি।
নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেখানকার হিন্দুদের মন–মানসিকতায় বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান। তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মুসলিম যুবক আরিফের বিরুদ্ধে এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার জেরে শহরে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর উসকানিতে মুসলিমদের ওপর হামলা শুরু হয়। দোকান ভাঙচুর, মারধর, বাড়িতে পাথর নিক্ষেপ—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
ভয়ে রাতের আঁধারে ধীরে ধীরে পালিয়ে যেতে থাকে মুসলিম পরিবারগুলো। হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন নন্দনগরে। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনও ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।
‘আমাকে কেউ দেখে না, আমি যেন অদৃশ্য ছায়া’
হাসান বলেন, ‘এখানে আমার জন্ম, এখানেই বড় হয়েছি। এটা ছেড়ে যাব কোথায়?’ তবে তাঁর জীবন আগের মতো নেই। প্রতিবেশীরা আর কথা বলেন না, তাঁর দিকে তাকান না পর্যন্ত। তিনি আর নদীর ধারে হাঁটেন না, পরিবারকে ঘরের বাইরে যেতে দেন না।
নিজেই নিজের ড্রাই ক্লিনিং দোকান খোলেন, আবার বন্ধ করেন, কিন্তু আগের মতো কাস্টমার নেই। হিন্দুদের ভয়ে কেউ আসতেও চায় না। ‘ধর্মের কারণে আমার পেশা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত,’ আক্ষেপ করে বলেন হাসান।
আদালতে মামলা, তবুও নিরাপত্তাহীনতা
ঘটনার পর হাসান ও আরেকজন মুসলিম ব্যক্তি হাইকোর্টে নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেন। আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিলেও বাস্তবে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করেনি। বরং মুসলিমদের বলা হয়, তারা কেন নিরাপত্তার দায় নিচ্ছে না।
নির্যাতন, বয়কট, প্রতিরোধ
হাসানের পরিবার এখনো সামাজিক বয়কটের শিকার। স্কুলে মেয়েকে ধর্ম নিয়ে অপমান করা হয়েছে। দোকান সংস্কারে হিন্দু শ্রমিকরা সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো স্থানীয়দের হুঁশিয়ারি দিয়েছে যেন মুসলিমদের সাহায্য না করা হয়।
তবু আশার ঝিলিক
তবে পাঁচ মাস পর, একদিন এক হিন্দু প্রতিবাদকারী নিজেই হাসানের দোকানে আসেন জামা-কাপড় পরিষ্কার করাতে। হাসানের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘ভুলে যান আগের কথা। আপনার কাজ ভালো, তাই এসেছি।’ হাসান বলেন, ‘এই দিনটা আমি দেখেছি কারণ আমি পালাইনি।’
নন্দনগরে ধর্মীয় সহিংসতা কমলেও সামাজিক নিপীড়ন চলছেই। তবুও হাসান আশা হারাননি। তিনি বলেন, ‘নন্দনগরই আমার পরিচয়। এখানেই লড়াই করব, এখানেই থাকব।’
সূত্র: আল-জাজিরা
রাকিব