
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের ১,১৪৩তম দিনে বিশ্বজুড়ে চলছে উত্তেজনা, উদ্বেগ ও কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ। সামরিক সংঘর্ষ, অস্ত্রচুক্তি, যুদ্ধবিরতির আলোচনা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা,সবকিছু মিলিয়ে এই যুদ্ধ এক জটিল মোড় নিচ্ছে।
যুদ্ধের মাঠে কী ঘটছে?
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে মাত্র ৩০ মিনিটে তারা ১৩টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে ৯টি ধ্বংস হয়েছে ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তঘেঁষা রোস্তভ অঞ্চলে এবং ৪টি উত্তর সীমান্তের কুরস্ক অঞ্চলে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজ শহর ক্রিভি রিহ পরিদর্শনে গেছেন, যেখানে এক সপ্তাহ আগে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১৯ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৯ জন ছিল শিশু-কিশোর।
এদিকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি টার্গেট তালিকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে-চলতি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালিয়ে সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
বড় অভিযান ও চীনের জড়িত থাকার অভিযোগ
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাশিয়া অচিরেই নতুন হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা যুদ্ধবিরতির আলোচনায় চাপ সৃষ্টি করার কৌশল হতে পারে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অভিযোগ, রাশিয়ার পক্ষে চীনের শত শত নাগরিক যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, রাশিয়ার দখলদার বাহিনীর অংশ হিসেবে কয়েক শত চীনা নাগরিক যুদ্ধ করছে।”
তবে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এদের অনেকেই ভাড়াটে সেনা, যারা সরাসরি চীনা সরকারের অধীনে নয়। তবে চীনা সামরিক কর্মকর্তারা রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থেকে যুদ্ধ থেকে কৌশলগত শিক্ষা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলেনস্কি আরও জানান, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতিরিক্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আলোচনা
শুক্রবার, রাশিয়ায় মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আলোচনা হয়। যদিও ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি, তবে ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আবারো ফোনালাপ হতে পারে।
ট্রাম্প এক Truth Social পোস্টে লেখেন, “রাশিয়াকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। হাজার হাজার মানুষ মরছে-একটি যুদ্ধ, যা কখনোই হওয়া উচিত ছিল না, এবং আমি প্রেসিডেন্ট থাকলে কখনোই হতো না!!!”
রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিশ্লেষকদের মতে, কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সীমিত যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রেও গড়িমসি করছে।জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস বলেন, “রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনে শিগগিরই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউজ সাইট Axios জানায়, এ মাসের মধ্যে যদি যুদ্ধবিরতিতে অগ্রগতি না হয়, তবে ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
এমনকি ইউক্রেনকে যুদ্ধশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বার্লিনের মতো বিভক্ত করার চিন্তাও উঠে এসেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত জেনারেল কিথ কেলগ The Times-এ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউক্রেনকে পশ্চিম ও পূর্বে ভাগ করে একটি নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে পশ্চিমে থাকবে ব্রিটিশ-ফরাসি বাহিনী, আর পূর্বে রাশিয়ার বাহিনী।
সামরিক সহায়তা
ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রায় ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিলি সতর্ক করেছেন, “২০২৫ সাল হতে যাচ্ছে এই যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর।”
এস্তোনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, তারা বৈশ্বিক অস্ত্র বাজার পর্যবেক্ষণ করছে এবং ইউক্রেনের জন্য আরও অস্ত্র কেনার সুযোগ দেখছে।যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইউক্রেন দাতাদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না, তবে ভিডিওর মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন।
নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা
যুক্তরাজ্যে রাশিয়ার এক প্রাক্তন মন্ত্রী, যিনি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে পরিবারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়েছিলেন, তাকে তিন বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে রাশিয়ায় দখলদারিত্বকালে ক্রিমিয়ার গভর্নর ছিলেন।
এদিকে ফিনল্যান্ড উপসাগরে রাশিয়ার "ছায়া নৌবহর"-এর একটি তেল ট্যাঙ্কার আটক করেছে এস্তোনিয়ার নৌবাহিনী।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতি
যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপ থেকে ১০ হাজার সেনা প্রত্যাহারের চিন্তা করছে বলে এনবিসি নিউজ জানিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইউরোপের জন্য উদ্বেগের বিষয় এবং ওয়াশিংটন ও মস্কোর ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আগামী এক দশকে নৌবাহিনী আধুনিকায়নের জন্য ৮.৪ ট্রিলিয়ন রুবল (প্রায় ৯৭ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ড্রোন, রোবট প্রযুক্তি এবং জিরকন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন।
অন্যদিকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “তারা জনগণের চেয়ে রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়েই বেশি মনোযোগী।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিদিনের প্রতিচিত্র শুধু যুদ্ধের খবর নয়, বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন ছকের দিক নির্দেশ করছে। শান্তির আশায় যে আলো ক্ষীণভাবে জ্বলছে, তা কোনো কূটনৈতিক ঘুঁটির ভুল চালেই নিভে যেতে পারে।
সূত্র:আল-জাজিরা
আফরোজা