
ছবি: সংগৃহীত।
ফিলিস্তিনের গাঁজা শহর থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে অবস্থিত কিবুটস এলাকায় ১৯৩০-এর দশকে পোল্যান্ড থেকে আগত ইহুদিরা কৃষি খামার গড়ে তোলেন। তাদের পাশেই বসবাস করত ফিলিস্তিনি আরবরা। সে সময় মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।
কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশকে ইহুদিরা গাঁজায় বসবাস শুরু করে এবং ক্রমশ দলবদ্ধভাবে সেখানে আসতে থাকে। তারা জমি ক্রয় করতে থাকে। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। তারা ভেবেছিল, সমস্যার সমাধান হলে দ্রুতই ঘরে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ইসরাইল তাদের আর কখনোই বাড়ি ফিরতে দেয়নি।
ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ প্রায় এক দশক আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "ফিলিস্তিনিদের এই দশা কেন হলো, সে প্রশ্ন তাদের নিজেদেরই করা উচিত।"
১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছিল। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল ব্রিটেনের অধীনে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনী তুর্কি সেনাদের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং তখন থেকেই ইহুদিদের রাষ্ট্র গঠনে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে একটি চিঠি পাঠান, যা পরে "বেলফোর ঘোষণা" নামে পরিচিতি পায়। সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটেনের সহায়তার কথা উল্লেখ ছিল।
ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ও নিপীড়নের ফলে তাদের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়। ১৯৩৩ সালের পর হিটলার জার্মানির শাসক হলে ইহুদিদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। হাজার হাজার ইহুদি জাহাজে করে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে। ফিলিস্তিনি আরবরা তখন বুঝতে পারে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
আরবরা বিদ্রোহ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সৈন্য ও ইহুদি বসতি। তবে ব্রিটিশ বাহিনী কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করে, যার ফলে আরব সমাজে বিভক্তি দেখা দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনী লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষ হলে বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন উঠে—এই বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের কোথায় রাখা হবে? তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা আরও গতি পায়।
আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। তিনি চান, এক লাখ ইহুদিকে দ্রুত ফিলিস্তিনে আশ্রয় দেওয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন জানত, এতে গৃহযুদ্ধ বাধবে।
ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তখন ব্রিটিশ সৈন্যদের লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। ফিলিস্তিনগামী জাহাজগুলো আটকে দেওয়া হলেও খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদিরা ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্রিটেন জাতিসংঘের কাছে যায়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। যদিও ইহুদিরা মোট জমির মাত্র ১০ শতাংশের মালিক ছিল, তবু তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অর্ধেক ভূমি। আরবরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে।
এরপরই শুরু হয় সংঘর্ষ। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে আসে। তাদের গোপন অস্ত্রকারখানাও ছিল। সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের সুসংগঠিত নেতৃত্ব। বিপরীতে, আরবদের কোনো ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব ছিল না।
১৯৪৮ সালের মার্চে ইহুদিরা আরবদের ওপর পাল্টা হামলা শুরু করে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, তখন ইহুদিরা আরবদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল।
১৪ মে, ১৯৪৮ সালে ইহুদি নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেন। এর এক ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচটি আরব দেশ—মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া—একযোগে ইসরাইলের ওপর হামলা চালায়। ইসরাইলি বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ হাজার, এবং তারা একপর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়।
পরে আবার যুদ্ধ শুরু হলে ইসরাইলি বাহিনী একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে। তারা তেল আবিব ও জেরুজালেমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবশেষে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে আরেকটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই সংঘাতের ইতি ঘটে।
এই যুদ্ধে প্রায় ৬,০০০ ইহুদি নিহত হয়। তারা মনে করে, যদি সেই যুদ্ধে হেরে যেত, তাহলে আরবরা তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিত। তবে যুদ্ধ শেষে ইসরাইল সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। বিপরীতে, ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।
নুসরাত