
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা যখন মধ্যপ্রাচ্যকে এক অনিশ্চিত বিভীষিকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তখন দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধারা। লোহিত সাগরে ইসরায়েলি ও তাদের মিত্রদের জাহাজে লাগাতার হামলা এবং সর্বশেষ তেল আবিবে সরাসরি ড্রোন হামলা চালিয়ে এ গোষ্ঠী প্রমাণ করেছে—তারা শুধু কথায় নয়, কাজে করেই ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
তবে প্রশ্ন উঠছে— এই হুথি যোদ্ধারা কারা? তাদের স্বার্থটাই বা কী?
হুথি আন্দোলন, যার আনুষ্ঠানিক নাম আনসারুল্লাহ (অর্থাৎ “আল্লাহর সমর্থক”), একটি শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন। নব্বই দশকে ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল হুথি গোত্র। এর প্রতিষ্ঠাতা নেতা হুসেইন আল-হুথি, যিনি জাইদি শিয়া মতবাদের পুনর্জাগরণ ঘটানোর লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু করেন। এক সময় ইয়েমেন শাসন করা জাইদি সম্প্রদায় ১৯৬২ সালের গৃহযুদ্ধের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পড়লে তাদের প্রান্তিকতা থেকেই এই আন্দোলনের জন্ম।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হুথিদের উত্থান ঘটে ২০০৩ সালে, যখন ইয়েমেন সরকার মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইরাক যুদ্ধকে সমর্থন করে। সেই সুযোগে স্থানীয় জনবিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে হুথিরা জনসমর্থন অর্জন করে। ২০০৪ সালে সরকার বাহিনীর হাতে হুসেইন আল-হুথি নিহত হলেও আন্দোলনের গতি কমেনি। বরং, একে সশস্ত্র রূপ দেওয়া হয়। তরুণরা দলে দলে যোগ দিতে থাকে এই সশস্ত্র সংগ্রামে।
২০১১ সালের আরব বসন্তের ঢেউ ইয়েমেনেও এসে লাগে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সুযোগ নিয়ে হুথিরা সাআদা প্রদেশসহ উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০১৪ সালে রাজধানী সানা দখল করে নেয়। এমনকি রাষ্ট্রপতির বাসভবনও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। এর মাধ্যমে ইয়েমেনের বড় একটি অংশে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে তারা।
ইরানের সহায়তায় হুথিরা সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের ইরানের সরাসরি হাতিয়ার হিসেবে না দেখে বরং নিজস্ব স্বার্থ ও ভিত্তিতে গঠিত একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিশ্লেষকরা মূল্যায়ন করেন।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় হুথিদের অবস্থান আরো দৃঢ় হয়। গত নভেম্বরে তারা ফিল্মি কায়দায় একটি ইসরাইলি বাণিজ্যিক জাহাজ হেলিকপ্টার দিয়ে দখল করে ইয়েমেনে নিয়ে যায়। এরপর নিয়মিত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকে লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর ওপর। ফলে বহু আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি বিকল্প পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, যা বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র একটি সামরিক জোট গঠন করে ইয়েমেনে পাল্টা হামলা শুরু করে। তবে হুথিরা জানিয়ে দিয়েছে, যতদিন না গাজার অবরোধ তুলে নেওয়া হচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধ হচ্ছে, ততদিন তারা প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে।
শুধু তাই নয়, তারা সম্প্রতি তেল আবিবে সরাসরি ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যা ইয়েমেনেই তৈরি ‘ইয়াফা’ নামক ড্রোন ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়। ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারী এই হামলাকে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যার জবাব বলে উল্লেখ করেছেন।
জেনারেল সারী বলেন, “আমাদের ভূমি, আকাশ ও জলসীমায় শত্রুদের কোনো অনুপ্রবেশ সহ্য করব না। প্রতিটি হামলার জবাব দিতে আমরা প্রস্তুত।” শুধু ইসরায়েল নয়, লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস ট্রুম্যানের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধমূলক অভিযান চালানোর কথাও জানান তিনি।
বিশ্লেষকদের মতে, হুথিদের এই প্রতিরোধমূলক ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের প্রতি নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়া এই গোষ্ঠী নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে এবং আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিতে এসব পদক্ষেপকে ব্যবহার করছে।
বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং আহত হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই পটভূমিতে হুথিদের প্রতিরোধ শুধু সামরিক দিক থেকে নয়, বরং মানবিক ও রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতিতে হুথিরা এখন আর শুধু ইয়েমেনের আঞ্চলিক গোষ্ঠী নয়—তারা হয়ে উঠছে একটি আঞ্চলিক বাস্তবতার অংশ, যারা ফিলিস্তিনের জন্য নিজেদেরকে লড়াইয়ের মাঠে প্রমাণ করছে।
এম.কে.