
ছবি: সংগৃহীত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানি করা গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর ২৫% নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধকে আরও তীব্র করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, এই নতুন শুল্ক ২ এপ্রিল কার্যকর হবে। আমদানি করা গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক পরদিন থেকেই আরোপ করা হবে, তবে যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক কার্যকর হবে মে মাস বা তার পর থেকে।
তিনি দাবি করেছেন, এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি শিল্পে "অসাধারণ প্রবৃদ্ধি" আনবে এবং দেশটিতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে, দাম বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
বৈশ্বিক গাড়ি বাজারে প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র গত বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন গাড়ি আমদানি করেছিল, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার (£১৮৬ বিলিয়ন)। দেশটির মোট গাড়ি বিক্রির প্রায় অর্ধেকই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান গাড়ি সরবরাহকারী দেশ, এরপর রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কানাডা ও জার্মানি। ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির ফলে বৈশ্বিক গাড়ি বাণিজ্য ও সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অনেক মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি মেক্সিকো ও কানাডায় কারখানা স্থাপন করেছে, যা উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (NAFTA) আওতায় পরিচালিত হয়। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, নতুন শুল্ক শুধু সম্পূর্ণ গাড়ির ওপর নয়, বরং আমদানি করা যন্ত্রাংশের ওপরও আরোপ করা হবে। তবে কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশ আপাতত শুল্কের আওতার বাইরে থাকবে।
শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব
ট্রাম্পের ঘোষণার পর বুধবার জেনারেল মোটরসের শেয়ারের দাম প্রায় ৩% কমে যায়। সেই ধাক্কা লাগে অন্যান্য গাড়ি নির্মাতার ওপরও, যার মধ্যে ফোর্ডের শেয়ারও উল্লেখযোগ্য হারে পতিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, "যদি আপনি যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি তৈরি করেন, তাহলে কোনো শুল্ক নেই।"
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এই শুল্ককে "অগ্রহণযোগ্য" বলে মন্তব্য করেছেন এবং বলেছেন, তার সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে "সব ধরনের ব্যবস্থা বিবেচনা করবে"।
জাপান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি রপ্তানিকারক দেশ। ট্রাম্পের ঘোষণার পর টোকিও শেয়ারবাজারে টয়োটা, নিশান ও হোন্ডার শেয়ারের দাম কমে যায়।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে "কানাডার গাড়ি শিল্পের ওপর সরাসরি আক্রমণ" বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, "এটি আমাদের জন্য ক্ষতিকর, তবে আমরা একসঙ্গে থাকলে এই সংকট থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবো।"
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, "শুল্ক হলো কর—যা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর এবং ভোক্তাদের জন্য আরও খারাপ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজবে, তবে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থও সংরক্ষণ করবে।"
যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি রপ্তানি বাজার। গত বছর ব্রিটেনভিত্তিক জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার মার্কিন ক্রেতাদের কাছে ১,১৬,২৯৪টি গাড়ি বিক্রি করেছিল, যা যুক্তরাজ্য ও চীনের চেয়েও বেশি।
ব্রিটেনের গাড়ি শিল্পের সংগঠন সোসাইটি অফ মোটর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স (SMMT)-এর প্রধান নির্বাহী মাইক হাওয়েস ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে "তড়িঘড়ি একটি চুক্তি করার" আহ্বান জানিয়েছেন।
মার্কিন অর্থনীতিতে প্রভাব
মার্কিন গাড়ি শিল্প ইতোমধ্যেই স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন শুল্কের ফলে গাড়ির দাম কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। অ্যান্ডারসন ইকোনমিক গ্রুপ অনুমান করেছে, শুধু মেক্সিকো ও কানাডার যন্ত্রাংশের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হলে প্রতিটি গাড়ির মূল্য ৪,০০০ থেকে ১০,০০০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
একদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা হুন্দাই ঘোষণা করেছিল যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ২১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে একটি নতুন স্টিল প্ল্যান্ট স্থাপন করবে। ট্রাম্প এই বিনিয়োগকে "শুল্ক নীতির সফলতা" বলে দাবি করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতারা ট্রাম্পের শুল্ক নীতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আমেরিকান অটোমোটিভ পলিসি কাউন্সিল-এর প্রধান ম্যাট ব্লান্ট বলেছেন, "মার্কিন গাড়ি নির্মাতারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুল্ক নীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়বে এবং মার্কিন ভোক্তারা উচ্চ মূল্যে গাড়ি কিনতে বাধ্য হবেন।
সূত্র: বিবিসি
সায়মা ইসলাম