
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫% আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বিশ্ববাজারে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। মঙ্গলবার, ভারত থেকে যাওয়া একটি বিশাল সমুদ্রগামী কার্গো জাহাজ ফ্লোরিডার টাম্পা বে বন্দরে পৌঁছায়। জাহাজটি শত শত টন অ্যালুমিনিয়াম নিয়ে গিয়েছিল, যা আলাবামার মোবাইল ও টেক্সাসের হিউস্টনে সরবরাহ করার কথা ছিল।কিন্তু শুল্ক কার্যকর হওয়ার একদিন আগে, পুরো জাহাজের পণ্য তৎক্ষণাৎ নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়!
Mercury Resources-এর ব্যবসায়িক উন্নয়ন ব্যবস্থাপক জোসে সেভেরিন জানান, "একজন ক্লায়েন্টের জাহাজ তিনটি মার্কিন বন্দরে থামার কথা ছিল, কিন্তু শুল্কের কারণে প্রথম স্টপেই সব মাল নামিয়ে ফেলতে হয়েছে। কারণ দ্বিতীয় গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই নতুন শুল্ক কার্যকর হয়ে যেত।"
টাম্পা বে বন্দরে জাহাজের মাল খালাস করে তা ট্রাকে করে গন্তব্যে পাঠানোই শুল্ক দেওয়ার চেয়ে সস্তা হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের বিশৃঙ্খলা এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নানা খাতে দেখা যাচ্ছে।
বাড়ছে পণ্যের দাম, চাপ বাড়ছে শিল্প ও ভোক্তার ওপর
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির ফলে মার্কিন স্টিলের দাম এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফোর্ড মোটর কোম্পানি সতর্ক করেছে, "এই অতিরিক্ত পরিবহন খরচ আমাদের পুরো গাড়ি শিল্পে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।"
শুধু গাড়ি শিল্প নয়, নির্মাণ, প্রযুক্তি ও ভোক্তা পণ্য শিল্পও শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কানাডা ও মেক্সিকো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি স্টিল সরবরাহকারী দেশ—পাল্টা প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে, যা উত্তর আমেরিকার দীর্ঘদিনের সমন্বিত সরবরাহ চেইনে বড় ধাক্কা দিতে পারে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব
কানাডার অন্যতম স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান Algoma Steel Group Inc. শুল্ক ঘোষণার পরপরই সীমান্তে ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মাইকেল গার্সিয়া বলেন, "আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম যদি কোনো ছাড় আসে, কিন্তু বাধ্য হয়েই সরবরাহ বন্ধ করেছি।"
Heidtman Steel Products Inc.-এর বিক্রয় পরিচালক ড্যান ডিমারে বলেন, "আমদানিকৃত স্টিল মার্কিন বাজারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ২৫% শুল্ক দিতে হচ্ছে। এই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের মতো কোম্পানির ওপর পড়ে, এবং এর ফলাফল ভোক্তাদেরই ভোগ করতে হয়।"
ফোর্ডের ক্ষেত্রে, "তারা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সরবরাহ চেইন ভাঙবে না। বরং এই অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা বহন করবে, যা শেষ পর্যন্ত গাড়ির দাম বাড়িয়ে দেবে," ডিমারে ব্যাখ্যা করেন।
শুল্ক কি মার্কিন শিল্পের জন্য ভালো নাকি ক্ষতিকর?
ট্রাম্পের দাবি, এই শুল্ক নীতি মার্কিন উৎপাদকদের সাহায্য করছে। তবে বাস্তবে, দেশীয় নির্মাতারা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে, কিন্তু সাধারণ ভোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চাপে পড়ছে।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশীয় স্টিল কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৭৫% ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং মহামারির পর থেকে দুটি বড় অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বন্ধ রয়েছে। ফলে, উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানির ঘাটতি পূরণ করা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যুদ্ধ: কে আসলে লাভবান?
ব্রাজিল, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টিল রফতানিকারক দেশ, সতর্ক করেছে যে তারা বিকল্প বাজার খুঁজতে বাধ্য হবে। দেশটির স্টিল সংস্থা Aço Brasil জানিয়েছে, "মার্কিন শুল্ক নীতির কারণে সস্তা চীনা স্টিল আমেরিকার পরিবর্তে অন্যান্য বাজারে প্রবাহিত হতে পারে।"
বিশ্বের বৃহত্তম স্টিল উৎপাদক চীন গত বছর প্রায় রেকর্ড পরিমাণ রফতানি করেছে, এবং এখন মার্কিন শুল্কের কারণে অতিরিক্ত সরবরাহ এশিয়া, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বাজারে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের বাজার রক্ষায় নতুন ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির ফলে আপাতদৃষ্টিতে দেশীয় স্টিল নির্মাতারা সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু এই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তাদের ঘাড়েই চাপছে।
ড্যান ডিমারে বলছেন, "বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।"
সূত্র :https://tinyurl.com/a89kd2y7
আফরোজা