
ছবিঃ সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন, কানাডা এবং মেক্সিকো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পর বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে ব্যাপক পতন ঘটেছে।
ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ২৫% এবং চীনের ওপর ২০% শুল্ক আরোপ করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীন ও কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, আর মেক্সিকো জানিয়েছে যে তারা পরিস্থিতি মোকাবিলায় "বিকল্প পরিকল্পনা" গ্রহণ করবে। এতে বিশ্বব্যাপী পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশ্ব শেয়ারবাজারে ধস
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ঘোষণার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্টক মার্কেট সূচক—ডাও জোন্স, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ এবং নাসডাক—বড় পতনের শিকার হয়। একই সঙ্গে, যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক মঙ্গলবার নিম্নমুখী অবস্থানে খোলে, এবং এশিয়ার শেয়ারবাজারেও পতন লক্ষ্য করা যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন পরিবারগুলোর জন্য পণ্যের দাম বাড়তে পারে এবং এই প্রভাব বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভোক্তাদের জন্য মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা টার্গেট-এর প্রধান নির্বাহী ব্রায়ান কর্নেল সতর্ক করেছেন যে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডো ও কলার মতো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে।
ফোর্ডের প্রধান নির্বাহী জিম ফারলি বলেন, "আমরা সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহের শুল্কের চাপ সামলাতে পারব, কিন্তু এর বেশি হলে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে, যা শিল্প খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস ও সম্প্রদায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও পাল্টা পদক্ষেপ
ট্রাম্প তার শুল্ক আরোপের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ মাদক ও অভিবাসনের প্রবাহ বন্ধ করার দাবি করেছেন।
এদিকে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ফেন্টানিলের ১% এরও কম আসে কানাডা থেকে। আমাদের বিরুদ্ধে নেওয়া এই পদক্ষেপ অন্যায্য এবং আমরা পাল্টা ব্যবস্থা নেব।"
ট্রুডো জানিয়েছেন, কানাডা প্রথমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করবে এবং পরবর্তী ২১ দিনের মধ্যে বাকি ১২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপরও শুল্ক বসানো হবে।
চীনও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যের ওপর ১০-১৫% শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে গম, ভুট্টা, গরুর মাংস ও সয়াবিন রয়েছে। চীন হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৃষিপণ্য আমদানিকারক।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, "যদি যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক যুদ্ধ বা অন্য যে কোনো ধরনের যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তবে চীন শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে।"
মেক্সিকোর প্রস্তুতি
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম বলেছেন, "এই পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখা দরকার। আমাদের হাতে পরিকল্পনা রয়েছে—প্ল্যান এ, প্ল্যান বি, প্ল্যান সি এবং এমনকি প্ল্যান ডিও রয়েছে।"
তিনি মঙ্গলবার আরও বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে জানান।
শুল্কের প্রভাব: অর্থনৈতিক ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় এবং তাদের অর্থনীতিগুলো একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চেম্বারের অ্যান্ড্রু উইলসন বলেন, "আমরা ১৯৪০ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শুল্ক বৃদ্ধির মুখোমুখি, যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।"
ইয়েল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই শুল্ক ব্যবস্থা মার্কিন পরিবারের জন্য বছরে গড়ে ২,০০০ ডলার অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হতে পারে।
গাড়ি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
টিডি ইকোনমিক্স-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গাড়ির দাম প্রায় ৩,০০০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে, কারণ একটি গাড়ি তৈরি করতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মার্কিন, কানাডিয়ান এবং মেক্সিকান সীমান্ত একাধিকবার অতিক্রম করে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৯০% অ্যাভোকাডো আমদানি হয় মেক্সিকো থেকে, যা দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।
কানাডার ১ বিলিয়ন ডলারের ম্যাপল সিরাপ শিল্প বিশ্ববাজারের ৭৫% চাহিদা পূরণ করে, তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এর দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও ব্রিটিশ ব্যবসার উদ্বেগ
নিউটন ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট-এর প্রধান এল্লা হক্সা বলেন, "ভোক্তারা খুব শিগগিরই পণ্যের দাম বাড়তে দেখবে, কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাড়তি খরচ ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেবে।"
ব্রিটিশ চেম্বার অফ কমার্স ইন চায়নার ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিস টরেন্স বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কের ভাঙনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তবে, যুক্তরাজ্যের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।"
ইমরান