ভূমধ্যসাগর হয়ে লিবিয়া দিয়ে ইউরোপে মানবপাচার
মৃত্যুর ঝুঁকি থাকার পরও ভূমধ্যসাগর হয়ে লিবিয়া দিয়ে ইউরোপে মানবপাচার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ভূমধ্যসাগর মৃত্যুকূপ জেনেও ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে মানবপাচার করা হচ্ছে। প্রতিবছরই লাশ হয়ে ফিরছে পাচারের শিকার মানুষ। উন্নত জীবনযাপন আর বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভনে পড়ে ঝুঁকি নিচ্ছে বেকার যুবকরা। ইউরোপ যাওয়ার পথে প্রতিবছরই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবে মর্মান্তিকভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি বিভাগের পরিচালক এএইচএম মাসুম বিল্লাহ নিশ্চিত করেছেন, লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ব্রেগার পশ্চিমে আল-আকিলা এলাকা থেকে অন্তত ২০ জনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক বলে লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা। বাংলাদেশ দূতাবাস ইতোমধ্যে একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। নৌকাডুবির ঘটনায় মৃতদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষের মতে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়ার পর এসব মৃতদেহ ব্রেগা তীরে ভেসে এসেছে। গত ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগরে হয়ে একটি নৌকা ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওই নৌকায় অনেক বাংলাদেশী নাগরিক ছিলেন। নৌকাটি ডুবে গিয়ে লাশ ভেসে আসছে লিবিয়া উপকূলে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৮টি রুট দিয়ে মানবপাচার হচ্ছে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে। মানবপাচারের জন্য পাচারকারীরা বেছে নিচ্ছে ভূমধ্যসাগরের মতো মৃত্যুকূপ। বিগত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর দিয়ে পাচার করা হয়েছে সাড়ে ২০ লাখ মানুষ। এ সময়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুসারে, কেবল ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগরে প্রায় দুই হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪০১। ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে, সেই তালিকার শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশের নাম।
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, দেশের অন্তত ১৫ জেলায় মানবপাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত দেশী-বিদেশী ২৮ চক্র। এর মধ্যে দেশের ভেতরে থাকা ১৮ চক্রের তিন শতাধিক সদস্য সক্রিয়। ভূমধ্যসাগর দিয়ে পাচারের জন্য লিবিয়ায় সক্রিয় আছে আরও চার চক্র। এসব চক্র মিলে লিবিয়া হয়ে ইতালি-ইউরোপে মানবপাচার করছে। মানবপাচারকারী চক্রের শতাধিক সদস্য পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজছে সিআইডি।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ বেশি হচ্ছে। অপরাধী হয়তো দেশের বাইরে আছে। তারা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে টাকা নিচ্ছে। তাকে ভুক্তভোগীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। প্রতারিত হলেও মূল আসামিকে দেখছে না ভুক্তভোগী। আবার ভাইবার, ইমো ব্যবহার করে তাকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে, খুব সহজে টার্গেট করা হচ্ছে।
সিআইডি ও র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন আট বাংলাদেশী। তবে এরকম ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও উন্নত জীবনের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময় বহু বাংলাদেশী হতাহত হয়েছে। লিবিয়ার নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশীসহ ৮২ জনকে উদ্ধার করে, যার মধ্যে মৃত আটজনসহ ৩২ জন বাংলাদেশী নাগরিক।
গ্রেপ্তার মানবপাচারকারী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দিতে মানবপাচারের ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। তদন্তে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশকালে তিউনিসিয়ার জলসীমায় কয়েকজন বাংলাদেশীর প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
তারা হলো লিবিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী বাংলাদেশ সিন্ডিকেটের নেতা মোশারফ কাজীর ছেলে যুবরাজ কাজী (২৪) ও আরেক নেতা রহিম শেখের ভাই কামাল শেখ (৩৮)। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সংঘবদ্ধভাবে খুনের ৩০২/৩৪ ধারা এবং মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১৯ এপ্রিল মামলা করার দুদিন পরই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলাটি করেন নিহত সজল বৈরাগীর পিতা সুনীল বৈরাগী।
এজাহারে সুনীল বৈরাগী অভিযোগ করেন, তার ছেলে সজল বৈরাগী উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যেতে ইচ্ছুক ছিলেন। সজলের পূর্বপরিচিত যুবরাজ কাজী (২৪) এবং লিবিয়ায় থাকা মোশারফ কাজী ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে বৈধপথে ইতালি পাঠানোর প্রস্তাব দেন। সজল বৈরাগী ও তার পরিবার এই প্রস্তাবে রাজি হয়। দুই পক্ষের সম্মতিতে যুবরাজ কাজীর গোপালগঞ্জের বাসায় আড়াই লাখ টাকা এবং পাসপোর্ট দেন সজল।
৩০ ডিসেম্বর তাকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। বিমানবন্দরে প্রবেশের পূর্বে গাড়ি থেকে নামার আগেই সজলের কাছ থেকে আরও নগদ পাঁচ লাখ টাকা নেয় যুবরাজ কাজী। এরপর দুবাই রওনা হন তিনি। গোপালগঞ্জের বাসায় গিয়ে যুবরাজ কাজীর হাতে আরও সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে আসেন পিতা সুনীল বৈরাগী। কিন্তু এরপর থেকে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি সুনীল।
এরপর গণমাধ্যমে সুনীল বৈরাগী জানতে পারেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর চারটার মধ্যে লিবিয়া থেকে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করা একটি ট্রলারে যে আট বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন, তার মধ্যে সজল রয়েছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, যুবরাজ কাজী, মোশারফ কাজী, রহিম শেখ, কামাল শেখসহ আরও প্রায় ২০ জন পারস্পরিক যোগসাজশে নিহতদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করে। তারা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও উত্তাল সাগরে ছোট নৌকায় তুলে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে তাদের মৃত্যু ঘটান।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মোশারফ কাজী ও রহিম শেখ লিবিয়ায় থাকে। সেখানে তাদের ঠিকানা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের আটকে রেখে পাচার করা হয়। তাদের আত্মীয়স্বজনরা স্থানীয়ভাবে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও আশপাশের জেলার লোকজনকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে টাকা সংগ্রহ করে অবৈধপথে ইউরোপ পাঠান। এদের অনেকেই ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারান।
বেঁচে যাওয়া নৌকার আরোহীর অভিজ্ঞতা ॥ দুর্ঘটনায় পড়া ওই নৌকার আরোহী ছিলেন মাদারীপুরের বুলু শেখ (৪০)। তিনি বলেছেন, রাত নয়টার দিকে আমাদের লিবিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাইকে ছোট একটি নৌকায় উঠতে বলা হয়। আমরা উঠতে রাজি হইনি। কিন্তু পরে উঠতে বাধ্য হই। বুলু শেখ বলেন, ওই নৌকায় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ জন উঠতে পারে।
সেখানে ৩৪ বাংলাদেশীসহ ৫৩ জন মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে আট পাকিস্তানি ও সুদানের দুই নাগরিক ছিলেন। তিনি বলেন, সজলসহ যে আটজন মারা গেছে, তাদের বেঁধে নৌকার পাটাতনের নিচে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওই চেম্বারে ডিজেলের বড় বড় কন্টেনার ছিল। বুলু শেখ বলেন, ছয় থেকে সাত ঘণ্টা চলার পর নৌকা ডুবে যেতে থাকে।
তখন আমরা যারা পাটাতনে বসেছিলাম, তারা সবাই পানিতে ঝাঁপ দেই। নৌকার যে অংশ ভেসে ছিল সেটি ধরে ভাসতে থাকি। নৌকা থেকে ৩০টির বেশি ডিজেল কন্টেনার ফেলে দেই, যাতে আমরা ভাসতে পারি। তিনি বলেন, তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড আমাদের উদ্ধার করে। এরপর আইওএম’এর সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশের উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ গমনের চেষ্টাকালে ২০২৩ সালে তিন হাজারেরও বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী মৃত্যুবরণ করেছেন এবং নিখোঁজ হয়েছেন। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী। তারা তাদের নজরদারি জোরদার করেছে। ফলে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপযাত্রা অত্যন্ত বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছেন ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশী, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে দুই হাজার ৪৮, পরের বছর দুই হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে তিন হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছে ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ’ বাংলাদেশী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৩ লাখেরও বেশি মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে। একই সময়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে ২৭ হাজার ৬৮২ জন। যাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশী আছে। প্রতিবছর গড়ে কমপক্ষে ৫০০ বাংলাদেশী এভাবে প্রাণ হারায়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩১ থেকে ৩৫ বছরের যুবকরা বেশি অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। গত সাত বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া ফেরত তিন হাজারের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা জানিয়েছে, অবৈধভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে একেকজনের খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। যাতে তরুণরা বৈধভাবে বিদেশে যেতে উৎসাহী হয়। আর দালালদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মানবপাচার থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। বরং মানবপাচারে কৌশল পাল্টেছে পাচারকারী চক্র। এক সময়ে পরিচিতদের মাধ্যমে বা সরাসরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফুঁসলিয়ে বা লোভ দেখিয়ে করা হয় মানবপাচার। এখন তারা আশ্রয় নিচ্ছে ফেসবুক, টিকটক, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে মানবপাচারের পথ বেছে নিয়েছে পাচারকারী চক্র। মানবপাচার বন্ধ করতে হলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনের প্রয়োগ করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে, যাতে অন্যরা নিরুৎসাহী হয়।