সৌদি আরব। এক স্বাধীন রাষ্ট্র যার নামকরণই হয়েছে শাসক পরিবার আল সৌদের নামে। ইতিহাসে এমন ঘটনা অনন্য। সরাসরি কোন পরিবারের নামানুসারে একটি দেশের নামকরণের দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে সৌদি রাজ পরিবারের গুরুত্ব এ ক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্রের পরিচয়ে স্থায়ীভাবে জড়িত।
সৌদি আরবের রাজ পরিবার হাউজ অব সউদ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ইতিহাসে এক প্রভাবশালী নাম। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই সৌদি রাজপরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুইটি বিষয়। ধর্মীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্য এবং আরব উপদ্বীপের গোত্র ভিত্তিক ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার পরিসর প্রসারিত করা।
তবে ইতিহাস জুড়েই দেখা গেছে বাহ্যিক শত্রুদের মোকাবেলা ছাড়াও সৌদি রাজপরিবারকে সামলাতে হয়েছে পরিবারের অভ্যন্তরে নানারকম দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার লড়াই।
১৭৪৪ সালে মহম্মদ বিন সউদ ও ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের মধ্যে আঁতাতের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের। ধর্মীয় দিক দিয়ে ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কারমুখী চিন্তাধারা ও গোত্র বদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই রাষ্ট্র বিস্তার লাভ করে। তবে অটোমান সাম্রাজ্যের সমর্থিত বাহিনীর আক্রমণে ১৮১৮ সালে এ রাষ্ট্রের পতন ঘটে। প্রথম রাষ্ট্রের পতনের পরও সৌদি রাজপরিবার তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট থাকে। ১৮২৪ সালে ফিরে আসে দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র। কিন্তু শাসনব্যবস্থা ধরে রাখতে গিয়ে আল রশিদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং উত্তরাধিকার সংকট এই রাষ্ট্রকেও স্থিতিশীল থাকতে দেয়নি। শেষমেশ ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়।
১৮৯১ সালে সৌদি রাজপরিবারের অবস্থা ছিল একেবারে শোচনীয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তরুণ নেতা আবদুল আজিজ ইবনে আব্দুর রহমান, যিনি ইবনে সউদ নামে পরিচিত। ১৯০২ সালে রিয়াদ পুনরুদ্ধার করে নিজের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন।
তেলের খনি আবিস্কারের আগেই তিনি গোত্রীয় জোট, বিবাহ সম্পর্ক এবং কৌশলী আলোচনার মাধ্যমে আরব উপদ্বীপের একটি বিশাল অংশকে নিজের কর্তৃত্বের অধীনে আনেন। ১৯৩২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সৌদি আরব। ইবনে সউদ দক্ষ সামরিক নেতা ও রাজনৈতিক কৌশুলি ছিলেন। গোত্র পতিদের সন্তুষ্ট রাখতে তিনি বিয়ে শাদির মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করেন।
আবার প্রয়োজন অনুযায়ী কঠোর সামরিক অভিযান চালিয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে রাখেন। এভাবেই তিনি সৌদি আরবকে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ১৯৫৩ সালে ইবনে সউদের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন বড় ছেলে সউদ।
কিন্তু তার অনুজ ফয়সাল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও কূটনৈতিক দক্ষতা সম্পন্ন নেতা। রাজ্যের অর্থনৈতিক, প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্কারে ফয়সালের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বড় ভাই সউদের শাসন ছিল অপব্যয়ী ও প্রশাসনিকভাবে দুর্বল।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। শেষমেশ ১৯৬৪ সালে উলামাদের সমর্থন ও পরিবারের অংশ বিশেষের সহায়তায় ফয়সাল বড় ভাই সৌদকে গদিচ্যুত করে নিজেই বাদশাহ হন।
বাদশাহ ফয়সাল ক্ষমতায় আসার পর বহু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সৌদি আরবের মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তারই ভাইপো প্রিন্স ফয়সাল বিন মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিশ্ব দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়। একটি প্রভাবশালী পরিবারের ভেতরের ক্ষমতার সংঘাত কতটা সহিংস হতে পারে, এই হত্যাকাণ্ড তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। ফয়সালের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন খালেদ।
তিনি তুলনামূলকভাবে নমনীয় হলেও স্বাস্থ্যগত কারণে দেশের শাসন কার্যক্রম পুরোপুরি সামলাতে পারতেন না। ফলে পর্দার আড়ালে শক্তিশালী কিছু প্রিন্স, বিশেষ করে একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া সাত সহোদর যাদের বলা হয় সুদাইলি সেভেন, তারা ধীরে ধীরে সামরিক, বেসামরিক ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পর তাদেরই একজন ফাহাদ সিংহাসনে বসেন। সেভেন এর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল তাদের পারস্পরিক সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব। তাদের শাসনামলে সৌদি আরব তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হন। তবে পরিবারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শাখা বংশের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কখনোই পুরোপুরি স্থিতিশীল ছিল না। ১৯৯০ থেকে ৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ, তেলের বাজারে অস্থিরতা ইত্যাদি নানা কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপে পড়েন বাদশাহ ফাহাদ।
তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ক্ষমতার বলয় সরতে থাকে সৎভাই আবদুল্লাহর দিকে, যিনি সুদাইরি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। ফলে সুদাইরি সেভেন বনাম অন্যান্য ভাইদের এক অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আব্দুল্লাহ ধীরে ধীরে ওলামা, গোত্রপতি এবং রাজপরিবারের বিভিন্ন শাখাকে নিয়ে নিজের বলয় তৈরি করেন। কার্যত বাদশাহ ফাহাদ হয়ে পড়েন পুতুল রাজা আর আবদুল্লাহ হয়ে ওঠেন প্রশাসনের অন্যতম চালিকাশক্তি। ২০০৫ সালে ফাহাদ মারা গেলে আবদুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে বাদশাহ হন। তিনি এলিগেন্স কাউন্সিল গঠন করেন, যেখানে উত্তরাধিকারের বিষয়টি যৌথভাবে নির্ধারণের কথা ছিল। ২০১৫ সালে আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে সিংহাসনে বসেন সুদানি সেভেনের অন্যতম সদস্য সালমান। ক্ষমতায় এসেই তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে থাকেন। অল্প বয়সেই মোহাম্মদ বিন সালমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন শুরু করেন। আগে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ।
অত্যন্ত ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র। কিন্তু ২০১৭ সালে তাকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়ে। একই বছরের রিটজ কার্লটন হোটেলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে বেশ কয়েকজন প্রিন্স ও শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তির বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক সমঝোতায় যেতে বাধ্য হন। সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার অবস্থান প্রতি দশকেই পাল্টেছে। বিশাল তেলের রাজস্ব, আন্তর্জাতিক মিত্র ও মিত্রদের সঙ্গে কূটনৈতিক দেনদরবার, আরব অঞ্চলের প্রাচীন গোত্র প্রথার ঐতিহ্য সব কিছুর মিশেলে এখনো ক্ষমতাসীনরা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনো কোনো প্রিন্স গৃহবন্দী হচ্ছেন, কখনো বা কাউকে দূতাবাসের হাল ধরে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। কেউ আবার দীর্ঘদিন প্রশাসনের শীর্ষ অবস্থান সামলানোর পর হঠাৎই পদচ্যুত হচ্ছেন। উন্নয়নের নামে কিংবা সংস্কারের ডাক দিয়ে যেসব পরিবর্তনের কথা প্রচার করা হয়, সেগুলোর বাস্তবায়ন কেমন হবে তা নির্ভর করে রাজপরিবারের ভেতরের স্বার্থ অদৃশ্য চুক্তি ও ক্ষমতার সমীকরণের ওপর।
শাসনব্যবস্থায় এডিটরস কাউন্সিল থাকলেও শেষ কথা বরাবরই বলেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী বলয়ের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। সৌদি রাজপরিবারের দীর্ঘ ইতিহাসে ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও গোত্রগত ঐতিহ্য সব সময় ক্ষমতার মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে এসেছে। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও উত্তরাধিকার সংকট রাজপরিবারের শাসনকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছে। কালের পরিক্রমায় সংস্কারের ডাক উঠলেও শেষ কথা বরাবরই বলেছেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজ পুত্রগণ।
ভিডিও: https://youtu.be/Bj3mQ8_xVcM?si=7OtiHPmjJc6p45-X
ফুয়াদ