প্রিন্সেস ডায়ানা ও রানী এলিজাবেথ
ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সবচাইয়ে জনপ্রিয় সদস্য ছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা। একবার তিনি বলেছেন, আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ ভালো বেসেছে। শুধু একটি মানুষ ছাড়া। যাকে আমি ভালো বেসেছিলাম। ডায়ানা ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস এর প্রথম স্ত্রী। তিনি এক সাধারন পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। তবে তার জীবনে মোড় ঘুরে গিয়েছিল। যখন তিনি প্রিন্স চার্লস এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সাধারন মানুষের কাছে এতো জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাকে বলা হয় পিপলস প্রিন্সেস। তার মতো জনপ্রিয়তা রাজ পরিবারের কোন সদস্যরা আর কখনো পাননি।
তার জীবনে শুরুটা কোন রুপকথার গল্পের চেয়ে কম ছিলনা। কিন্তু শেষটা ছিল খুবই ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক। তার কাছে সব কিছু থাকলেও ছিল না ভালোবাসার মানুষ। কখনো পাননি ভালোবাসার মানুষটির কাছে কোন সম্মান। শেষে বাধ্য হয়ে রাজ পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলেছিলেন।
তবে তার নিয়তিতে ছিল এক মর্মান্তিক পরিনতি। বিবাহ বিচ্ছেদের মাত্র এক বছরের মাথায় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু নিয়ে বহু ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়। এবার প্রশ্ন হলো প্রিন্সেস ডায়ানার সাথে কি হয়েছিল। যে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন রাজ পরিবারের সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করতে। আর কেন তাকে বলা হয় পিপলস প্রিন্সেস।
ডায়ানার জন্ম হয় ১ জুলাই ১৯৬১। তিনি প্রিন্সের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যা ব্রিটেনের ছিল এক উচ্চবিত্ত পরিবার। এমনকি ডায়ানার বাবা জন স্পেন্সার ইংল্যান্ডের রাজা কিং জর্জ এবং পরে রানী এলিজাবেথ এর অধীনে কাজ করেছেন। তবে এত উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ডায়ানার জীবন ছিলো খুবই সাধারন।
তিনি সুইজার ল্যানেডর একটি বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়া করেন।
লেখাপড়া ছাড়াও তিনি নাচ, গান, পিয়ানো ইত্যাদিতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। ডায়ানার বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর। তখন তিনি প্রথমবার চার্লসের সাথে দেখা করেন। তখন চার্লসের বয়স ছিল ২৯ বছর। এই সময় প্রিন্স চার্লস ডায়ানারই এক বোনের সাথে সম্পর্ক ছিলেন। চার্লস তখন অনেক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল। আর এই সময় তার বহু মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন।
এর দুই বছর পর ডায়ানা লন্ডনে থাকতে শুরু করেন। তিনি তখন একটি স্কুলে লেখা শিক্ষিকা ছিলেন এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন। যার জন্য তিনি ঘন্টায় ৫ ডলার করে পেতেন। চার্লসের ৩০তম জন্মদিনের পার্টিতে ডায়ানা আমন্ত্রিত ছিলেন। আর বলা হয় এখান থেকেই চার্লসের সাথে ডায়ানার বন্ধুত্ব শুরু হয়। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়। তবে এই সম্পর্কে ডায়ানা যতটা জড়িয়ে ছিলেন চার্লস ততটা নয়।
কিন্তু ডায়ানার কাছে এই বিষয়টা স্পষ্ট ছিলোনা। তিনি চার্লসের নামে অনেক রিউমার শুনতেন। তবে, তিনি তা বিশ্বাস করতে না। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক এ্যাঙ্কেজম্যানে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন। আপনারা কি একজন আরেকজনকে ভালোবাসেন। তখন ডায়ানা সরাসরি উত্তর দিলেও চার্লস বলেন ভালোবাসার মানে কি? ঠিক তখনই ডায়ানার মনে সন্দেহ শুরু যে তিনি বড় ভুল করেছেন।
এ্যাঙ্কেজম্যানের কিছু দিনের মধ্যে লন্ডনের তার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে তিনি বাকিংহামে চলে যান। তবে বাকিংহাম প্যালেসে তিনি একাকিত্ব অনুভব করেন। দিনে বেশিরভাগ সময় তিনি বিয়ের প্রস্তুতি এবং ডেন্সিং অনুশীলন করে সময় কাটান।
বিশাল বড় বাকিংহাম প্যালেসে তার সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ ছিলনা। ডায়ানা ভেবেছিলেন যে তিনি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু তত দিনে মিডিয়া আর পৃথিবীর অনেক মানুষ জেনে গিয়েছিলো। আর তখন সেই সম্পর্ক থেকে পিছিয়ে আসার কোন উপায় ছিলনা।
অবশেষে ডায়ানার ২০তম জন্মদিনের ৩ সপ্তাহ পরে ২৯ জুলাই ১৯৮১ সালে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়। তাদের বিয়ের লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়। তাদের বিয়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ দেখেছে। এছাড়া সরাসরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের শুভেচ্ছা জানায়।
বিয়ের আগে মাত্র ১৩বার তিনি চার্লসের সাথে দেখা করে ছিলেন। আর তিনি বিয়ের আগের দিন জানতে পেরেছিলেন যে, চার্লস তাকে ভালোবাসেনা। কারণ চার্লসের অন্য এক মহিলার সাথে সম্পর্ক ছিল। যার নাম ছিল ক্যামেলিয়া। যিনি বর্তমানে চার্লসের স্ত্রী। ক্যামেলিয়া সেই সময় বিবাহিত ছিলেন। যার কারণে চার্লস ক্যামেলিয়াকে যদি বিয়ে করতো। তাহলে ক্যামেলিয়াকে আগে তার স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিতে হতো। আর এই সময় চার্লস ক্যামেলিয়াকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু রাজ পরিবারে তখন কোন বিবাহিত মেয়েকে বিবাহ করার নিয়ম ছিলোনা। চার্লস এই কারণে ডায়ানাকে বিয়ে করার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের ভালোবাসা ছিল একতরফা। বিয়ের পর যখন তিনি বাকিংহাম প্যালেসে থাকতে শুরু করেন। তখন তিনি অনেক সমস্যার সম্মখীন হন। রাজ পরিবারের বাকি সদস্যরা তার প্রতি আন্তরিক ছিলোনা। অপরদিকে চার্লসের সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্কের অবনতি হয়। একটা সময় ডায়ানা রানী এলিজাবেথের কাছে সাহায্য চান।
রানী সেই সময় তাকে বলেন, আমি জানি না তোমার কি করা উচিত। চার্লসের উপরে আমি ও ভরসা করতে পারি না। রাজপরিবারে ধীরে ধীরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ডায়ানার।
এক সাক্ষাৎকারে ডায়ানা বলেছিলেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হতো আত্মহত্যা করি। এরপর তিনি দুই ছেলের জন্ম দেন। যার নাম প্রিন্স উইলিয়ামস ও প্রিন্স হ্যারি। তবে এত সমস্যা থাকলেও তিনি সাধারন মানুষের কাছ থেকে কখনো মুখ ফিরিয়ে নেননি। রাজ পরিবারের অন্য সদস্যরা যেখানে মানুষের কাছ থেকে দুরে থাকতেন। সেখানে তিনি সবার সাথে মিশতেন।
তিনি ব্রিটেনের জনগণের কাছে বাড়ির এক জন সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। এইডস এবং এইচআইভি নিয়ে সে সময় মানুষের মনে অনেক মিথ্যা ধারনা ছিল। অনেকে মনে করতেন যে এইডস আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে এইডস ছড়ায়। কিন্তু তিনি এক এইডস রোগীর সাথে স্পর্শ করে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এছাড়া তিনি স্কুলে বাচ্চাদের মায়েদের সাথে বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করেন। অনেক সময় তিনি তার প্রটোকল ভেঙ্গে সাধারন মানুষের সাথে মিশে যেতেন।
প্রসঙ্গগত, ডায়ানার জন্ম ১ জুলাই ১৯৬১। বরাজ চার্লসের প্রথম স্ত্রী এবং ১৯৮১ হতে ১৯৯৭ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের যুবরাজ্ঞী ছিলেন। ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে বিবাহের পর থেকে ১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ডায়ানাকে বলা হত পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান মহিলা। ফ্যাশন, সৌন্দর্য এবং এইডস রোগ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে তার অবদান, এবং ভূমি মাইনের বিরুদ্ধে তার আন্দোলন তাকে বিখ্যাত করেছে। তার জীবদ্দশায় ডায়ানাকে বলা হত বিশ্বের সর্বাধিক আলোকচিত্রিত নারী।
১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে বিবাহের পর থেকে ১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত তাকে হার রয়াল হাইনেস দি প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স বলে সম্বোধন করা হত। এর পরে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের আদেশক্রমে তাকে শুধু ডায়ানা, প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স বলে সম্বোধনের অনুমতি দেয়া হয়। তার পুত্র রাজপুত্র উইলিয়াম ও হ্যারি, ব্রিটিশ মসনদের উত্তরাধিকারীদের তালিকায় যথাক্রমে প্রথম ও পঞ্চম।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডায়ানার পরিচিতি ব্যাপক। তিনি দানশীলতার জন্য খ্যাত ছিলেন। কিন্তু তার এই দাতব্য কার্যক্রম ঢাকা পড়ে যায় বিভিন্ন কেলেঙ্কারীর গুজবে, যার মধ্যে ছিল তার বিয়ে সংক্রান্ত কাহিনী। চার্লসের সাথে ডায়ানার বিয়ে সুখে-শান্তিতে কাটেনি। নব্বইয়ের দশকে ডায়ানার পরকীয়া প্রেমের কাহিনী সারা বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। চার্লসের বিশ্বাসঘাতকতাসহ নানা কারণে অবশেষে ১৯৯৬-এ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ডায়ানা ও তার তখনকার প্রেমিক দোদি ফায়েদ এক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন।
শহীদ