লস অ্যাঞ্জেলসের দুটি বড় দাবানল নিয়ন্ত্রণে
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দুটি বড় দাবানল অবশেষে দমকল কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করেছেন। কারণ টানা কয়েকদিনের প্রচ- বাতাস শুক্রবার থেকে প্রশমিত হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি দাবানলে লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টির আশপাশের এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে এ পর্যন্ত অন্তত ১১ জনের মৃত্যু এবং ১০ হাজারেরও বেশি বাড়ি ও স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। খবর আলজাজিরা ও সিএনএন অনলাইনের।
দাবানল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর দমকলকর্মীরা বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি চালাবেন। তখন মৃতের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ গৃহহীন হয়ে পড়ায় এবং ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে কর্মকর্তারা জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। দমকল কর্মীরা শহরের পশ্চিম প্রান্তে প্যালিসেডস ফায়ার এবং বিস্তৃত মহানগরীর পূর্বদিকে পাহাড়ের পাদদেশে ইটনে দাবানল নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন।
তীব্র বাতাসের কারণে গত কয়েকদিন শত শত দমকল কর্মীর চেষ্টাতেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। অবশেষে প্যালিসেইডসের আগুন ৮ শতাংশ এবং ইটনের আগুন ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর আগে, ক্যালিফোর্নিয়ার দমকল বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবারের আগে প্যালিসেইডস ও ইটনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার মাত্রা ছিল শূন্য শতাংশ। যদিও এরই মধ্যে, ভয়াবহ দাবানলে এই দুই অঞ্চলের প্রায় ৩৪ হাজার একর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টির শেরিফ রবার্ট লুনা জানান, প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার লোককে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আরও ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ জনকে সরিয়ে নেওয়ার সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সাতটি প্রতিবেশী রাজ্য, ফেডারেল সরকার এবং কানাডা ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল নিয়ন্ত্রণে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টি ফায়ার চিফ অ্যান্থনি ম্যারোন দাবানল নিয়ন্ত্রণে জনবল বাড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সবাই এগিয়ে আসায় ভয়াবহতা এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।
এনডব্লিউএসের আবহাওয়াবিদ অ্যালিসন সান্তোরেল্লি বলেন, এখন দমকা হাওয়া নেই। তবে কম আর্দ্রতা এবং শুষ্ক গাছপালার কারণে পরিস্থিতি বিপজ্জনক বলে সতর্ক করেছেন তিনি। পূর্বাভাসকারীরা ধারণা করছেন, সোমবার আরও একবার জরুরি সতর্কতা জারি করা হবে। এদিকে দাবানলের ভয়াবহতার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসযজ্ঞের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দাবানলের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ওভাল অফিসে ব্রিফিংয়ের সময় শুক্রবার এই মন্তব্য করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, দাবানলের শিকার স্থানগুলো দেখে মনে হয়েছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে কেউ। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমাদের যুদ্ধের দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। দাবানলের সময় বিশৃঙ্খলার সুযোগে অনেক স্থানে লুটপাটের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বাইডেন। তিনি আরও বলেন, এই দুর্যোগ নিয়ে অনবরত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে গেছেন কেউ কেউ। লস অ্যাঞ্জেলসের কিছু স্থানে লুটপাটের আশঙ্কায় নৈশকালীন কার্ফু জারি করেছে কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া, নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী থেকে ন্যাশনাল গার্ড, সবাইকে কাজে নামিয়েছে সরকার। নাম উল্লেখ না করে দাবানল নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির ফায়দা নেওয়ার জন্য অনেক জনতুষ্টিবাদী নেতাকে আপনারা কোমর বেঁধে মাঠে নামতে দেখেছেন। প্যাসিফিক প্যালিসেডস একটি অভিজাত এলাকা।
এই এলাকায় তারকাদের বাস। দুইদিন আগের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাতাসে শুধু পোড়া গন্ধ। কালো ধোঁয়ায় ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। মুখে মাস্ক পরা বাসিন্দারা তাদের ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলো এক ঝলক দেখার আশায় এসেছিলেন। বিশ্বজুড়ে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের জন্য পরিচিত স্প্যানিয়ার্ড শেফ হোসে আন্দ্রেস প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়েতে প্যালিসেডস ফায়ারের কাছে একটি ফুড কার্ট বসিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ধনী হোক বা গরিব, এই মুহূর্তে সবারই একটু সমর্থন ও ভালোবাসা প্রয়োজন। হলিউড অভিনেতা জেমি লি কার্টিস বলেন, তার পরিবার ত্রাণে ১০ লাখ ডলার দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কর্মী ও ম্যাটেরিয়াল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধ ডজন রাজ্য ও কানাডার দমকল কর্মীদের ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টিতে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ দাবানল নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক বিবাদে জড়ালেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দাবানল শুরুর পর এখন পর্যন্ত তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি লস অ্যাঞ্জেলস কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই ডেমোক্র্যাটদের দোষারোপ করা শুরু করেছেন।
তাদের মধ্যে গভর্নর গ্যাভিন নিউসমের বিরুদ্ধে তুলেছেন নানা ধরনের ব্যর্থতার অভিযোগ। এসব অভিযোগের একটি, নিউসম পানির অপচয় করছেন। ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, ‘গ্যাভিন নিউজকামের (গভর্নর নিউসম) পদত্যাগ করা উচিত। সব তার ব্যর্থতা!’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘লস অ্যাঞ্জেলসের ভয়াবহ আগুন এটাই বলছে, ২০ জানুয়ারির জন্য আর অপেক্ষার সময় নেই।’ দিনটিতে জো বাইডেনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তিনি।
এটিকে বাইডেন-নিউজকাম জুটির চরম অক্ষমতা ও অব্যবস্থাপনার প্রতীক হিসেবে প্রকাশ পেতে দিন। একই দিন হোয়াইট হাউসে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক করেন বাইডেন। এ সময় ট্রাম্পকে পাল্টা আক্রমণ করে তিনি বলেন, এ দাবানল নিয়ে লোকজনের রাজনীতি করা উচিত নয়। প্রেসিডেনসিয়াল মেয়াদের শেষ পর্যায়ে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান গুরু পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে গতকাল বাইডেনের সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু দাবানল পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের দিনই এ সফর বাতিল করেন তিনি। ট্রাম্পের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বাইডেন বলেন, ‘আমি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে অফিস ছাড়ছি। কিন্তু এটি (দাবানল) রাজনীতির বিষয় নয়। এটি মানুষের মধ্যে এ নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দেওয়ার বিষয় যে আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব।’
ইতোমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ দাবানল মোকাবিলায় সহায়তা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অর্থ ও অন্যান্য উপকরণের জোগান দেওয়ার বিষয়ে নানা রকম ঘোষণা দেন জো বাইডেন। তবে ডেমোক্র্যাটদের অব্যবস্থাপনায় দাবানল নিয়ন্ত্রণে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকানদের এমন অভিযোগ খ-ন করতেই এ সময় বেশি আগ্রহী দেখা গেছে তাকে। ট্রাম্পের অভিযোগ, গভর্নর নিউসম তুষার গলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছেন।
এতে দাবানল নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাইডেন প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য, মূল সমস্যা বিদ্যুৎ নিয়ে। কেননা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আশঙ্কা, বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল থাকলে ত্রুটিযুক্ত সঞ্চালন লাইনের কারণে আগুন আরও ছড়াতে পারে। এ অবস্থায় পানির পাম্পগুলো বন্ধ আছে।