ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১

ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলে মৃত্যু বেড়ে দশ

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:১২, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলে  মৃত্যু বেড়ে দশ

.

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ছড়ানো দাবানল তৃতীয় দিনেও নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। দাবানলে প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়েছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। হতাহত আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটির একাধিক সূত্র। তবে আপাতত স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, হারিকেনের মতো বাতাসের গতি কিছুটা কমেছে। এতে দমকলকর্মীরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাটভাবে কাজ করতে পারছেন। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও সিএনএন অনলাইনের।  
দাবানাল প্যাসিফিক পলিসেডস অঞ্চলের পলিসেডস ফায়ার সান্তা মোনিকা ও মালিবুর মধ্যবর্তী পাহাড়গুলোর ১৫ হাজার ৮৩২ একর এলাকার ১০০০ স্থাপনা গ্রাস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটিতে কেন দাবানল এমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেই প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় খরা আর প্রবল বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়াচ্ছে। দাবানল এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেও কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও ঠিক কোন কোন বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী, সেটি এখন স্পষ্ট নয়। এই দাবানল সম্প্রতি টোপাঙ্গা ক্যানিয়ন থেকে এগিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে তা লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে অন্যতম ধ্বংসাত্মক দাবানল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর আগে অন্তত তিনটি ভিন্ন সূত্র আগুনে মোট সাতজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। যদিও লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শেরিফ রবার্ট লুনা সংখ্যাটি নিশ্চিত করেননি। তিনি এক  সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তদন্তকারী দলগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানোর সুযোগ না পাচ্ছে ততক্ষণ মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা সম্ভব না।
তবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তিনি ধারণা করছেন মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে এসব এলাকায় পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছে। মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে পারে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি প্রার্থনা করি এই সংখ্যাটা আর যেন না বাড়ে।
পূর্ব দিকে সান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালার পাদদেশে ইটনে আরও ১০ হজার ৬০০ একর, হাজার খানেক স্থাপনা পুড়ে গেছে। বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাসকারী অ্যাকুওয়েদারের প্রাথমিক হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আর্থিক মূল্যে তা পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ডেমোক্র্যাট মেয়র কারেন বাস বলেন, আমরা লস অ্যাঞ্জেলেস দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পুনর্নিমাণের দিকে মনোনিবেশ করছি। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ফেডারেল সরকার আগামী ১৮০ দিনের জন্য ধ্বংসাবশেষ অপসারণ, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রাথমিক উদ্ধারকারীদের পারিশ্রমিকসহ পুনরুদ্ধার ব্যয়ের শতভাগ বহন করবে।
হোয়াইট হাউসে সিনিয়র উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন বলেন, আমি গভর্নর ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের বলেছি, দাবানল নিয়ন্ত্রণে যেখানে যা খরচ করা দরকার সবটাই যেন সরকারের বরাদ্দ থেকে করা হয়।
সব মিলিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে পাঁচটি দাবানল জ্বলছে। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী বিলাল তুখি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার সময় বলেন, এই দৃশ্য তাকে তার আদি নিবাস, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে সুপারিনটেনডেন্ট আলবার্তো কারভালহো জানান, ধোঁয়া, ছাই ও কণার কারণে বাতাস দূষিত হয়ে পড়ায় শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের মতো স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে।
ইটন ফায়ারের ভয়াবহতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে রাতারাতি বাতাস আবার তীব্র হওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন। অবজারভেটরি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, অবজারভেটরির কাছে ইটন ফায়ারের আগুন আপাতত নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হচ্ছে।’
সবচেয়ে বড় দাবানলটি জ্বলছে প্যালিসেডস অঞ্চলে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দাবানলটি জ্বলছে ইটন অঞ্চলে। সানসেট, হার্স্ট ও লিডিয়া এলাকাতেও এখনো আগুন জ্বলছে। প্যালিসেডস এবং ইটন ফায়ার নামে দুটি বৃহত্তম দাবানল শহরের চারপাশে এত বিশাল কুণ্ডলী তৈরি করেছিল যে এটি মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান ছিল।
প্যাসিফিক প্যালিসেডস একটি অভিজাত এলাকা। এই এলাকায় তারকাদের বাস। দুইদিন আগের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাতাসে শুধু পোড়া গন্ধ। কালো ধোঁয়ায় ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। মুখে মাস্ক পরা বাসিন্দারা তাদের ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলো এক ঝলক দেখার আশায় এসেছিলেন। বিশ্বজুড়ে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের জন্য পরিচিত স্প্যানিয়ার্ড শেফ হোসে আন্দ্রেস প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়েতে প্যালিসেডস ফায়ারের কাছে একটি ফুড কার্ট বসিয়েছেন। তিনি বলেন, ধনী হোক বা গরিব, এই মুহূর্তে সবারই একটু সমর্থন ও ভালোবাসা প্রয়োজন। হলিউড অভিনেতা জেমি লি কার্টিস বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার পরিবার ত্রাণে ১০ লাখ ডলার দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কর্মী ও ম্যাটেরিয়াল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধ ডজন রাজ্য ও কানাডার দমকল কর্মীদের ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠানো হয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের প্রতিবেদনে জানা যায়, দাবানলের কারণে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ২ লাখের বেশি বাসিন্দা। এই অবস্থায় পরিত্যক্ত বাড়িগুলোয় লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। লুটের অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। কিছু এলাকায় কার্ফু ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তীব্র বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে স্থানীয় প্রশাসন রেড ফ্ল্যাগ সতর্কতা জারি করেছে। গ্যাসলাইনের সংস্পর্শে এসে আগুন যাতে ছড়িয়ে না যায়, সে জন্য বিভিন্ন এলাকায় সড়কপথ ধ্বংস করা হচ্ছে। গত দুই দিনে বাতাসের গতি বাড়তে থাকায় দাবানল দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে গেছে। প্যালিসেইডস ও ইটনে দাবানলে প্রায় ৩১ হাজার একর এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ও স্থাপনা। জেনিফার অ্যানিস্টন, ব্র্যাডলি কুপার, টম হ্যাঙ্কস, বেন অ্যাফ্লেক, মাইকেল কিটন, প্যারিস হিলটন, অ্যাডাম স্যান্ডলারসহ অনেক হলিউড তারকা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেরিফ রবার্ট লুনা বলেন, ক্ষয়ক্ষতির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এখানে যেন পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে! নিশ্বাস নিতে জামা দিয়ে মানুষ তাদের মুখ ঢেকে রাখছেন। অনেকে ব্যাগ ও স্যুটকেস হাতে যাওয়ার জায়গা খুঁজছেন। কিছু মানুষকে রাস্তায় পায়জামা পরা দেখা গেছে। হলিউডের বিখ্যাত সড়ক সানসেট বুলেভার্ডে বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় দাবানল শুরু হয়। এতে করে হলিউডের অধিকাংশ এলাকা ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, বাসিন্দাদের সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বুধবার স্থানীয় সময় মধ্যরাত নাগাদ একটি এলাকার প্রায় ৬০ একর পুড়ে গেছে। ভয়ে বহু তারকা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করেন। ভয় ও উদ্বেগ নিয়ে কিছু মানুষ কথা বলেন। আনা ওয়াল্ডম্যান নামের এক নারী বলেন, আমি কোথায় যাব? নিরাপদ জায়গা কোথায়ও আছে?’
পানির সংকট দেখা দেওয়ায় দমকলকর্মীরা সুইমিং পুল ও পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উডলি দাবানল নামে পঞ্চম দাবানলের মাত্রা কমলেও, অন্যান্য স্থানে এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
চটেছেন ট্রাম্প ॥ লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ দাবানল নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক বিবাদে জড়ালেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দাবানল শুরুর পর এখন পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি লস অ্যাঞ্জেলেস কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই ডেমোক্র্যাটদের দোষারোপ করা শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে গভর্নর গ্যাভিন নিউসমের বিরুদ্ধে তুলেছেন নানা ধরনের ব্যর্থতার অভিযোগ। এসব অভিযোগের একটি, নিউসম পানির অপচয় করছেন। ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে বলেন, ‘গ্যাভিন নিউজকামের (গভর্নর নিউসম) পদত্যাগ করা উচিত। সব তার ব্যর্থতা!’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ আগুন এটাই বলছে, ২০ জানুয়ারির জন্য আর অপেক্ষার সময় নেই।’ দিনটিতে জো বাইডেনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তিনি। এটিকে বাইডেন-নিউজকাম জুটির চরম অক্ষমতা ও অব্যবস্থাপনার প্রতীক হিসেবে প্রকাশ পেতে দিন। একই দিন হোয়াইট হাউসে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক করেন বাইডেন। এ সময় ট্রাম্পকে পাল্টা আক্রমণ করে তিনি বলেন, এ দাবানল নিয়ে লোকজনের রাজনীতি করা উচিত নয়। প্রেসিডেনসিয়াল মেয়াদের শেষ পর্যায়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান গুরু পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে গতকাল বাইডেনের সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাবানল পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের দিনই এ সফর বাতিল করেন তিনি। ট্রাম্পের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বাইডেন বলেন, ‘আমি খুব স্বল্পসময়ের মধ্যে অফিস ছাড়ছি। কিন্তু এটি (দাবানল) রাজনীতির বিষয় নয়। এটি মানুষের মধ্যে এ নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দেওয়ার বিষয় যে আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব।’ ইতোমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ দাবানল মোকাবিলায় সহায়তা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অর্থ ও অন্যান্য উপকরণের জোগান দেওয়ার বিষয়ে নানা রকম ঘোষণা দেন জো বাইডেন। তবে ডেমোক্র্যাটদের অব্যবস্থাপনায় দাবানল নিয়ন্ত্রণে পানির সংকট দেখা দিয়েছে- রিপাবলিকানদের এমন অভিযোগ খণ্ডন করতেই এ সময় বেশি আগ্রহী দেখা গেছে তাকে। ট্রাম্পের অভিযোগ, গভর্নর নিউসম তুষার গলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছেন। এতে দাবানল নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাইডেন প্রশাসন বলছে ভিন্নকথা। তাদের বক্তব্য, মূল সমস্যা বিদ্যুৎ নিয়ে। কেননা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আশঙ্কা, বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল থাকলে ত্রুটিযুক্ত সঞ্চালন লাইনের কারণে আগুন আরও ছড়াতে পারে। এ অবস্থায় পানির পাম্পগুলো বন্ধ আছে।

×