ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২৩:২৭, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতি বর্তমানে অভূতপূর্ব সংকটে আবদ্ধ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যের সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতি একদিকে স্বাধীন রাখাইন রাষ্ট্রের সমূহ সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অংশগ্রহণ আঞ্চলিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছে। আরাকান আর্মি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাপক সামরিক অগ্রগতি লাভ করেছে। তারা বিমানবন্দর, সামরিক ঘাঁটি এবং কৌশলগত স্থানগুলো দখল করে নিজেদের শক্তি সুসংহত করছে।

ইতোমধ্যেই রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী এক স্বাধীন রাখাইন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে, যা শীঘ্রই মিয়ানমারের ইতিহাসে পাল্টে দিতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মির স্বাধীন রাখাইন রাষ্ট্র ঘোষণা কেবল সময়ের ব্যপার। যদি তারা সফল হয় তবে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করবে। রাখাইন রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং বঙ্গোপসাগরে তার অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাখাইন পরিস্থিতিতে চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চীন তাদের বিনিয়োগ এবং কৌশলগত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জন্য রাখাইনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মিকে একটি পছন্দের গোষ্ঠী হিসেবে দেখছে এবং পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থন দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে সামরিক শাসনকে চাপে রাখতে চায় এবং রাখাইনের স্বাধীনতার সম্ভাবনা এই প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করছে।

রাখাইনের স্বাধীনতা অর্জিত হলে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাখাইন স্বাধীন হলে এই মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ঠ শরণার্থীরা কোথায় যাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে রাখাইন স্বাধীনতার পরও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে না।

অন্যদিকে, ভারতের মণিপুর রাজ্যেও সংঘাত গভীরতর হয়েছে। কুকি এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষ ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আধুনিক অস্ত্র এবং ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। ভারত সরকার সেখানে সেনা মোতায়েন করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে মণিপুরে একটি নতুন খ্রিস্টানপ্রধান রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চলছে, যা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মদদে পরিচালিত হতে পারে।

এই পরিস্থিতি শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ১২ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যার একটি বড় অংশ মুসলিম। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মুসলিম হওয়ায়, এ অঞ্চলে ধর্মীয় ও জাতিগত বৈপরীত্য আরও তীব্র হচ্ছে।

পাশাপাশি ভারতের আসাম -সহ বিভিন্ন রাজ্যে জাতীয় নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হওয়ায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরণার্থীর ঢল ধেয়ে আসতে পারে বাংলাদেশের দিকে- এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই অঞ্চলেও বেড়ে যেতে পারে জাতিগত সংঘাত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইন এবং মণিপুরের সংঘাতের এই জটিল অবস্থায় যদি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই সংঘাত আঞ্চলিক শক্তি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে, যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হবে।

এমনকি এই সংঘাতের ফলে রক্তক্ষয়ের পাশাপাশি অর্থনীতি, বাণিজ্য, কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে ও এর সরাসরি ভূক্তভোগী হতে পারে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের অন্তত ৪০ কোটি নাগরিক।

এম.কে.

×