ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের আসামে বাঙালিদের উপর সংঘটিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় 'নেলি গণহত্যা'। বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেলি গণহত্যায় মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে নগাঁও জেলার নেলি ও আশপাশের ১৪টি গ্রামে প্রাণ হারিয়েছিল তিন হাজারেরও বেশী বাঙালী মুসলমান।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ছিল ২,১৯১, তবে বেসরকারি সূত্রে এই সংখ্যা ৫,০০০-এরও বেশি বলে দাবি করা হয়। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন বাংলাভাষী মুসলিম, যাদের বিরুদ্ধে বেআইনি অভিবাসনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে ছিল আসামের দীর্ঘদিনের 'বিদেশি' বিতর্ক। মূলত উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো আসামের বাঙালিদের উপর নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে তাদেরকে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।
১৯৭৯ সালে আসামের মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনে ভোটার তালিকায় বিদেশি নাগরিকদের নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সদৌ অসম ছাত্র সংস্থা (আসু) এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিদেশি অভিবাসীদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করার অভিযোগ আনা হয়, যা কংগ্রেসের ভোটব্যাংক সুরক্ষার কৌশল হিসেবে মনে করা হয়। মঙ্গলদৈ উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত এই ইস্যু অসম আন্দোলনের জন্ম দেয়।
নেলি গণহত্যার আগে অঞ্চলটি ছিল টানটান উত্তেজনার মধ্যে। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনের সময় রাজ্যজুড়ে সহিংসতা বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন আসু'র বয়কটের আহ্বান উপেক্ষা করে ভোটগ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিস্থিতিতে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার আশ্বাস দিয়েছিল প্রশাসন।
১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে নেলি ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসীরা স্বাভাবিক কাজকর্মে বের হন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে তিনদিক থেকে সশস্ত্র আক্রমণকারীরা গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। গ্রামবাসীরা কপিলি নদীর দিকে পালানোর চেষ্টা করলেও সেখানেও তাদের উপর হামলা করা হয়। ছুরি, কুঠার, শাবলসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে চালানো হয় গণহত্যা। গ্রামগুলোর বাড়িঘর ও ধানের গোলাগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই গণহত্যায় জীবিত যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের অভিযোগ, কয়েক দিন আগেই তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ বা প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি হামলার আগের দিন এলাকায় নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েও পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল।
এই ঘটনার পর নিহতদের পরিবারকে মাত্র ৫,০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, যা অন্যান্য গণহত্যার ক্ষতিপূরণের তুলনায় অনেক কম। তদন্তে পুলিশ ৬৮৬টি মামলা দায়ের করেছিল, কিন্তু অধিকাংশ মামলাই তথ্যপ্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর অসম গণ পরিষদ ক্ষমতায় এসে এই মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
এই গণহত্যার বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হলেও তার প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অসম গণ পরিষদের বিরুদ্ধে এই ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ ওঠে। নেলি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে শিক্ষামূলক গবেষণা এবং তথ্য প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
নেলি গণহত্যা ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও আজও নেলি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে কোনো স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়নি। গণহত্যার শিকার পরিবারগুলো এখনও ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষায়।
এম.কে.