বাশার আল-আসাদ। ছবি: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে
সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ গেল ৮ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন। সেদিন প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে পালিয়ে যান রাশিয়ায়। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে ২৪ বছরের শাসনামলের অবসান হয়েছে আসাদের। ২০০০ সালে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন।
তাঁর আগে, বাবা হাফিজ আল-আসাদ একটানা ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন। এই নিয়ে অবসান ঘটেছে টানা ৫৩ বছরের শাসনের। এতগুলো বছর দেশটির ক্ষমতা আসাদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সিরিয়ায় এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সিরিয়া থেকে পালানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে কাউকেই কিছু জানাননি বাশার আল-আসাদ। আসাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, কর্মকর্তারা, এমনকি আত্মীয়রাও এ বিষয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন।
মস্কোতে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গত ৭ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রায় ৩০ জন সামরিক এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তার একটি বৈঠকে আসাদ বলেছিলেন, রুশ সামরিক সহায়তা আসছে। এবং পদাতিক বাহিনীকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর নিজেই জীবন বাঁচাতে মস্কোর উদ্দেশে পালিয়ে যান।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পালিয়ে যাওয়ার কয়ে ঘণ্টা আগে নিজ কার্যালয়ের ম্যানেজারকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার কথা জানান। আসলে বিমানবন্দরে চলে যান তিনি। আসাদ তার মিডিয়া উপদেষ্টা বুতাইনা শাবানকে বাসভবনে ডেকে বক্তৃতা লেখার কথা বলেন। শাবান সেখানে পৌঁছে তাকে না পেয়ে হতভম্ব হন।
আরব রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক নদিম হুরি বলেন, আসাদ তার সেনাদেরও শেষ পর্যন্ত একত্রিত করেননি। তিনি তাদের ভাগ্যের মুখে ছেড়ে দিয়েছেন।
বাশার আল-আসাদের স্ত্রীর নাম আসমা আসাদ। তিনি যুক্তরাজ্য ও সিরিয়ার যৌথ নাগরিক। পশ্চিম লন্ডনে একটি সিরীয় পরিবারে আসমার জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা। আসমা পেশায় ব্যাংকার ছিলেন।
এর আগে লন্ডনে পড়াশোনা করেন। ২০০০ সালে সিরিয়ায় চলে আসেন আসমা। বিয়ে করেন বাশার আল–আসাদকে। ওই বছরই বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুতে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের (এলএসই) ভিজিটিং ফেলো নাসরিন আলরেফাই বিবিসিকে জানান, আসমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট রয়েছে। কাজেই রাশিয়ায় থাকার পরিবর্তে তিনি চাইলে যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারেন।
নাসরিনের মতে, বাশারপত্নী আসমা হয়তো রাশিয়াতেই থেকে যেতে পারেন। কেননা, আসমার বাবা ফাওয়াজ আল–আখরাস নিজেও এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, আসমার বাবা ফাওয়াজ আল-আখরাস পেশায় চিকিৎসক। মা সাহার একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। মেয়ে আর মেয়ের পরিবারের পাশে থাকতে তাঁরা মস্কোয় থাকতে আগ্রহী।
আসাদ ও তার পরিবার বর্তমানে মস্কোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছে। তার ফ্লাইটটি রাডারের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল। রাজধানী দামেস্ক দখলের সময় বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তার এই পলায়ন।
পরাজয় আসন্ন। এটা বুঝতে পেরেও ইরানকে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেননি আসাদ। তার আশঙ্কা ছিল, এতে ইসরাইল তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। মস্কোর পক্ষ থেকেও সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়।
রয়টার্স বলছে, আসাদ প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে আবুধাবি। পরে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন পুতিন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ কাতারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তি করে আসাদকে মস্কোতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেন।
আসাদের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল জালালি জানান, পালানোর রাতেও আসাদ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছিলেন। শনিবার রাতে শেষ ফোনালাপে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামীকাল দেখা যাবে’।
১১ দিনের মধ্যে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায়। বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দ্রুত দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকায় আসাদ নিজেই স্বীকার করেন, তার সেনাবাহিনী প্রতিরোধে অক্ষম।
ইরানকে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য বলেননি তিনি । তার আশঙ্কা ছিল, এতে ইসরায়েল তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। এই পালানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ার ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের একটি অপ্রত্যাশিত পরিসমাপ্তি ঘটে। আসাদ তার জাতির জন্য রেখে যান এক বিধ্বস্ত ভবিষ্যৎ। বর্তমানে দেশটির বাস্তবতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটিই এখন প্রশ্ন? দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।
এসআর