ছবি: সংগৃহীত
ভারতে গরুর মাংস নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে দেশটির রাজনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ইস্যু। বিশেষত, আসামের সাম্প্রতিক আইন গরুর মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
জনসমক্ষে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে রাজ্য সরকার শুধু মুসলিমদের খাদ্যাভ্যাসে বাধা দেয়নি, বরং এটি তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপরও আঘাত।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মন্ত্রিসভার এই আইনটি মূলত আগের একটি আইনের সম্প্রসারণ। আগে নির্দিষ্ট ধর্মীয় স্থান, যেমন মন্দিরের আশেপাশে গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল।
এবার এই বিধি আরও কঠোর করে জনসমাগমস্থল, রেস্তোরাঁ এবং অনুষ্ঠানেও এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যদিও বাড়িতে গরুর মাংস খাওয়ার অনুমতি রয়েছে, জনসমক্ষে এই খাদ্যাভ্যাস নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মুসলিমদের সামাজিক জীবনকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়াও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের কারণে আসামে কয়েক লক্ষ বাঙালি মুসলমান নাগরিকত্ব হারিয়ে রাষ্ট্রবিহীন মানুষে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। ১৯৫১ সালের পর প্রথমবারের মতো হালনাগাদ হতে যাওয়া নাগরিকত্বের এই তালিকার ফলে সারা ভারতে প্রায় দুই কোটি বাঙালি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে বহিষ্কৃত হতে পারেন।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু হওয়ায় এই অনুভূতি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গত এক দশকে ক্রমেই বাড়ছে।
আসামে এই নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামাজিক উত্তেজনা বাড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম ব্যবসায়ী, গবাদি পশু বিক্রেতা, এমনকি নিম্নবর্ণের হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে।
এই পরিস্থিতি ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (র.)-এর সিলেট বিজয়ের গল্পও গরুর মাংসকে কেন্দ্র করে।
গৌড়গোবিন্দ নামে এক অত্যাচারী হিন্দু রাজা, যিনি মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতেন, বোরহান উদ্দিন নামে এক মুসলিমের শিশুকে কেবল একটি গরুর মাংসের টুকরো তার আঙিনায় পড়ার কারণে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এই ঘটনায় বোরহান উদ্দিন প্রতিশোধের জন্য দিল্লির সুলতানের কাছে সাহায্য চান।
সুলতানের নির্দেশে সিকন্দর গাজি সেনাবাহিনী নিয়ে গৌড়গোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তবে যুদ্ধে জাদুটোনার মাধ্যমে গৌড়গোবিন্দের শক্তি প্রমাণিত হয়। তখন হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সঙ্গী ৩৬০ জন আওলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী গৌড়গোবিন্দের সেনাদের পরাজিত করে এবং সিলেট অঞ্চলে শান্তি ও ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন।
এই ঐতিহাসিক বিজয় শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং অত্যাচারের বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিক শক্তির বিজয়ের প্রতীক। বর্তমান আসামে মুসলিমরা ঠিক সেই ধরনের অত্যাচারের মুখোমুখি। জনসমক্ষে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করা, গবাদি পশু রক্ষা গোষ্ঠীর মাধ্যমে হামলা, এবং সামাজিক নিপীড়ন যেন গৌড়গোবিন্দের যুগের অত্যাচারের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
তাহলে, আসামের মুসলিমদের জন্য শাহজালালের মতো একজন মুক্তিদাতা কি আবার আসবেন?
ইতিহাস বলে, নির্যাতন যতই দীর্ঘ হোক, প্রতিরোধ সবসময় উঠে আসে। তবে বর্তমান সময়ের সংগ্রাম হতে হবে ভিন্নধর্মী। হযরত শাহজালাল (র.) যেভাবে আধ্যাত্মিক শক্তি, একতা, এবং শান্তির মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, আসামের মুসলিমদেরও তেমনভাবে শিক্ষা, ধৈর্য, এবং ঐক্যের শক্তি ব্যবহার করতে হবে।
শাহজালালের মতো একজন নেতৃত্ব আসামেও উঠে আসতে পারে, তবে এই নেতৃত্ব এখন কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি থেকেও হতে হবে। এটি হবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম।
এম.কে.