ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ভৌগোলিকভাবে তিনদিক দিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং আসামের সঙ্গে একটি মাত্র স্থলপথে সংযুক্ত থাকায় ত্রিপুরাকে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়ার দাবিকে বাস্তবসম্মত করে তুলেছিল। তবে একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগত কারণে তা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি।
সে সময় এই ইস্যুতে ত্রিপুরার রাজপরিবার বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য মহারাজকুমার দুর্জয়কিশোর দেববর্মন এবং রিজেন্সি কাউন্সিলের মন্ত্রী সত্যব্রত মুখার্জী। তাদের সমর্থনে ছিলেন আঞ্জুমান-এ-ইসলামিয়ার নেতা আবদুল বারিক।
অন্যদিকে, রাজপরিবারের আরেক অংশ, ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠী এবং হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তানভুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতভুক্তির পক্ষে সোচ্চার হয়।
১৯৪৭ সালের ১৭ মে রাজা বীরবিক্রম কিশোর দেববর্মনের মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র কিরীট বিক্রম কিশোর দেববর্মন রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। এমতাবস্থায় প্রথা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার রাজ্য পরিচালনার জন্য গঠন করে রিজেন্সি কাউন্সিল বা পরামর্শক পরিষদ। এই কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিলেন মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবী। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই রাণী সেই রাজনৈতিক সংকটময় সময়ে ত্রিপুরাকে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করার পথে অগ্রসর হন।
জানা যায়, ব্রিটিশরা ভারত-ত্যাগের পরপরই গুজব রটে যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সৈন্যরা ত্রিপুরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে ভারত সরকার ত্রিপুরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আসাম থেকে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে এবং জরুরী বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বিষয়টি অবগত করা হয়।
জানা যায়, ত্রিপুরার মহারাণীও পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যোগদানে আগ্রহী ছিলেন। মহারাণীর বাংলাদেশে ( তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) যোগদান করার ইচ্ছে নিয়ে অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে।
অবশ্য মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী চাইলেও ত্রিপুরাকে পূর্ববঙ্গের সাথে যুক্ত করতে পারতেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কেননা সেসময় বিহারে দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী অঞ্চলে দাঙ্গা সৃষ্টি হলে বিরাট সংখ্যক বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করে। স্বাভাবিকভাবেই তখন হিন্দু প্রধান রাজ্য ত্রিপুরা এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ গড়ে উঠে। এই বিরোধ টপকিয়ে বাংলাভাষী এই দুই অঞ্চলকে এক করার মত যোগ্য কোনো নেতৃত্ব তখন ত্রিপুরায় ছিল না।
তাছাড়া, পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষী মুসলিম নেতৃত্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরাও পূর্ববঙ্গকে ভৌগলিকভাবে শক্তিশালী করার প্রতি মনোযোগী ছিলেন না। তাদের অদূরদর্শিতা ও অবহেলার কারণেই আরাকান রাজার আবেদন সত্ত্বেও আরাকানকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়নি। এমনকি হাতের কাছের আগরতলাও চলে যায় ভারতের করায়ত্তে।
অবশেষে, ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাবালক রাজা কিরিটী বিক্রম মাণিক্যের পক্ষে মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবী দিল্লিতে ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অংশ হয়।
ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তি রাজ্যটির সাড়ে ৫০০ বছরের রাজতান্ত্রিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায়।
ঐতিহাসিকভাবে, ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের শাসন ছিল এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়। রাজারা প্রথমদিকে পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন, তবে মোগল শাসক ও বাংলার নবাবদের কাছে তাদের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। ত্রিপুরার হাতির খ্যাতি ছিল সারা ভারতজুড়ে, যা মোগল দরবারে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ছিল। রাজারা বারবার মোগল দরবারে হাতি-কর দিতেন।
পরবর্তীতে, ব্রিটিশ শাসকরাও ত্রিপুরার স্বাধীনতাকে সীমিত করে। ব্রিটিশরা পলিটিক্যাল এজেন্টের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনার উপর কড়া নজর রাখত।
দেশভাগের সময় ত্রিপুরায় হিন্দু শরণার্থীদের ঢল এবং পূর্ব পাকিস্তানে ত্রিপুরা থেকে মুসলিম অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। রাজ্যটিতে প্রায় জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বর্তমানে বাঙালি ও হিন্দু। অতীতের সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি সম্প্রদায় এখন জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ।
এম.কে.