ইসকন
১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন)। এটি হলো গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের অনুসারী একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ইসকনের মূল ধর্মবিশ্বাসটি শ্রীমদ্ভাগবত, ভগবদ্গীতা ও অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রসমূহের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে ইসকনকে কিছু দেশে নিষিদ্ধ বা এদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করার পরেই তার সঙ্গে যে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের যোগ ছিল, সেই ইসকনকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, ইসকন উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে। ইসকনকে যেসব দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সব তথ্যও তুলে ধরে বাংলাদেশেও সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। যদিও বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন আমলে নেয়নি।
আবার ইসকন আসলেই হিন্দু ধর্ম প্রচার করে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক নজরে আসে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই। এই প্রতিবেদনে ইসকন আসলে কী কাজ করে, তার ওপরেই আলোকপাত করা হয়েছে।
পশ্চিমা দেশসহ বিশ্বের নানাদেশে ইসকনের লাখো ভক্ত ছড়িয়ে আছে। এদের মূল নাম ছাড়াও ইসকনের ভক্ত হিসাবে পৃথক একটি নাম দেওয়া হয়ে থাকে। ইসকনের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে ব্রহ্মচারীর জীবন বেছে নিয়েছেন। ইসকনের বিখ্যাত ও ‘কোটিপতি’ সদস্যদের মধ্যে আছেন ফোর্ড মোটর্সের মালিক হেনরি ফোর্ডের প্রপৌত্র অ্যালফ্রেড ফোর্ড, দ্য বিটলসের অন্যতম মুখ জর্জ হ্যারিসন, কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এবং অ্যাপেলের প্রাক্তন সিইও স্টিভ জবস।
বিখ্যাত মানুষদের সমাবেশ যেমন হয়েছে ইসকনে, তেমনই নানা সময়ে বিতর্কেও জড়িয়েছে ইসকন। যেমন: সংঘ-প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিক থেকেই সিঙ্গাপুরে ইসকন নিষিদ্ধ থেকেছে দীর্ঘকাল। সংঘটির রেজিস্ট্রেশন আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে পরে অন্য নাম নিয়ে সেদেশে শুরু হয় ইসকনের কর্মকাণ্ড, এখন সেখানে একটি মন্দির আছে এবং ইসকনের ভক্তরা খোলাখুলিই কাজ করেন।
এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখনও ইসকন তার কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। চিনেও তাদের গোপনে কাজ করতে হয় বলে ইসকনের ওয়েবসাইটে একটি পুরণো নিবন্ধে লেখা হয়েছে। তবে পাকিস্তানে ইসকনের অন্তত ১২টি মন্দির রয়েছে বলে সংঘটি দাবি করে। রাশিয়া সহ অনেক দেশে ইসকনের ধর্মীয় প্রচারণার পদ্ধতি নিয়ে মামলা হয়েছে নানা সময়ে।
হিন্দুত্ববাদের গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ইসকন নানা দেশে বিতর্কে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসবগুলোর কারণ একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম। ইসকনের বিভিন্ন সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ উঠেছে যে তারা আর্যতত্ত্বে বিশ্বাসী, বর্ণবাদী ইত্যাদি। শিশু হেনস্থার অভিযোগ এসেছে। বাংলাদেশে ইসকনের কার্যকলাপ নিয়ে বলা হচ্ছে যে তারা উগ্র এবং জঙ্গি ধর্মীয় সংগঠন। এটা বলা একেবারেই উচিত নয়। তারা হয়তো ধর্মীয় রক্ষণশীল সংগঠন, কিন্তু রক্ষণশীলতার প্রচার বিভিন্ন ধর্মের অনেক সংগঠনই করে থাকে।
তার কথায়, বাংলাদেশে ইসকনের বিরুদ্ধে যে মূল অভিযোগটা নানা সময়ে ওঠে, তা হলো ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যাপক ভক্ত সংখ্যা থাকায় তারা সেটাকে কাজে লাগিয়ে নানা সময়ে বাংলাদেশের নানা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ইসকনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু সন্ন্যাসীর মুখে ভারতে মূলত বিজেপি নেতা কর্মী সমর্থকদের মধ্যে প্রচারিত 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান শুনতে পাওয়া এই ভারত যোগের অভিযোগ দৃঢ় করেছে। এখানে ইসকনের সাথে ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ রাজনীতির ভারত-বিরোধী প্রবণতার প্রভাবে।
ইসকন কিছু দেশে নিষিদ্ধ বা এদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি সাধারণত স্থানীয় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে আরোপ করা হয়েছে। রাশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে ইসকনের কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। বিশেষত, তাদের শাস্ত্র এবং ধর্মীয় বই বিতরণ নিয়ে বিতর্ক চরমে উঠেছে। কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের মতো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ইসকনের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি জারি রয়েছে।
কিছু মুসলিমঅধ্যুষিত দেশে ইসকনের কার্যক্রমে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, তবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ইসকন বিশেষত হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার পক্ষে সরব অবস্থানে রয়েছে। তারা প্রায়ই মন্দির ধ্বংস, মূর্তি অবমাননা, এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়গুলোকে তথ্য-প্রমাণাদিসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরে। এ কারণে অনেক সময় তারা প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা সরকারের বিরাগভাজন হয়ে থাকে। অনেকে দাবি করেন, বাংলাদেশেও ইসকন সংখ্যালঘুদের পক্ষে সোচ্চার অবস্থানের কারণে তাদের নেতারা গ্রেপ্তার ও মামলার হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সাম্প্রতিককালে ইসকনের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে নানা আলোচনা তৈরি হয়। তাদেরকে ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে।
ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা প্রসাদ দাস বলেন, আমরা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সেবামূলক কাজ করি।
সূত্র: বিবিসি।
তাসমিম